Murshidabad is a city in a state of violence : ঘরের ভেতরে পাকা দেওয়াল, মাথার ওপরে ছাদ, চেনা উঠোন, জানালার পাশে রাখা শীতের রোদ্দুর, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মায়ের গলার গান—সব ছেড়ে আজ তারা এক স্কুলের বেঞ্চে গাদাগাদি করে দিন কাটাচ্ছে। পুলিশ পাহারায়। রাতে ভয় পায় চোখ বন্ধ করতে। দিনের আলোয় শান্তির খবর মেলে না। যেন নিজের রাজ্যেই উদ্বাস্তু হয়ে গেছে তারা। এমন এক অবিশ্বাস্য অথচ বাস্তব কাহিনি আজ unfolding হচ্ছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। সামশেরগঞ্জ ও ধুলিয়ান পৌরসভার ১৬ এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শতাধিক পরিবার, যারা হিংসার আগুনে ঘর ছেড়েছে, আশ্রয় নিয়েছে গঙ্গা পেরিয়ে মালদা জেলার বৈষ্ণবনগর বিধানসভার পারলালপুর হাই স্কুলে। যে স্কুলের প্রতিটি ঘর ক্লাসরুম হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আজ হুইসপার হয়ে আছে কান্না, আতঙ্ক আর তীব্র অনিশ্চয়তা।
ঘটনার সূত্রপাত সাম্প্রতিক একটি গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ থেকে। একটি স্থানীয় ইস্যু থেকে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা আগুনের রূপ নেয়। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, সামশেরগঞ্জ, লালগোলা সহ একাধিক এলাকায় হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। পুড়েছে ঘরবাড়ি, ভাঙা হয়েছে দোকান, রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্কের ছায়া। প্রাথমিক সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, জমি সংক্রান্ত বিবাদ এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক উত্তেজনা এই হিংসার মূল কারণ।
এদিন খবর পেয়ে “খবর বাংলা” প্রতিনিধি পৌঁছে যায় মালদার বৈষ্ণবনগরের সেই পারলালপুর হাই স্কুলে, যেখানে চলছে অস্থায়ী শরণার্থী শিবির। স্কুলের গেটেই চোখে পড়ে দুই বৃদ্ধা—একজনের কোলে নাতি, অন্যজন তাকিয়ে আছেন দূর আকাশে। প্রশ্ন করতেই চোখে জল জমে আসে, বললেন, “মরণটা ভালো ছিল বোধহয়, কিন্তু ঘর ছেড়ে এভাবে পালিয়ে আসা—এ যন্ত্রণার ভাষা নেই। আমাদের নিজের এলাকাতেই থাকতে পারছি না।” পাশে বসা মধুবালা বিবি জানান, “আমার স্বামী এখনো ওখানে আটকে আছে। আমি আর মেয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। প্রতিদিন খবর পাই, ওখানে এখনো লোকজনের বাড়ি পুড়ছে। রাতে ফোন বন্ধ করে দিই, ঘুম আসে না।”
এই শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন দেখা করতে আসছেন বহু আত্মীয়। কেউ মায়ের সাথে দেখা করতে, কেউ বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখে আবার ফিরছেন। এক তরুণী জানালেন, “আজ তিনদিন পর আমার মা-র সাথে দেখা হলো। বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে দিলাম। একটু দুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে, ওরও যেন আর ক্লান্তি নেই।”
এই দৃশ্য দেখে মন কেঁদে ওঠে। এ কেবল খবর নয়, এ এক চলমান মানবিক বিপর্যয়। একদিকে আতঙ্কে দিন কাটা, অন্যদিকে ভবিষ্যতের অস্পষ্টতা। আশ্রয় প্রার্থীদের একজন, মুশারফ হোসেন, বলেন, “আমরা তো চাই শুধু শান্তিতে বাঁচতে। কোনো রাজনীতি বুঝি না। এখন চাই সরকার যেন দ্রুত এলাকায় পুলিশ ক্যাম্প বসায়, BSF মোতায়েন করে। তাহলে অন্তত ঘরে ফিরতে পারব।”
মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতিমধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা অন্য কথা বলে। অগ্নিসংযোগের খবর এখনো আসছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। ফলে আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে।

এদিকে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। পারলালপুর হাই স্কুলে এখন আর ক্লাস হয় না। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, “আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজ মানবিক কারণে স্কুলকে শিবিরে পরিণত করতে হয়েছে। পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত, তবে এখন সবচেয়ে জরুরি এই মানুষগুলোর পাশে থাকা।”
স্থানীয় সমাজসেবীরা এগিয়ে এসেছেন খাদ্য, ওষুধ, পোশাক নিয়ে। মালদা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পাঠানো হয়েছে শুকনো খাবার ও স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু প্রয়োজনে অনেক বেশি ব্যবস্থা দরকার। এই পরিস্থিতি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, একটা সমাজ কীভাবে মুহূর্তে ভেঙে পড়ে, কতটা অরক্ষিত থাকে সাধারণ মানুষ।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সমাজতত্ত্ববিদ সুদীপ্ত বিশ্বাস বলেন, “এই ধরণের হিংসা ও তার ফলাফল একটা এলাকায় দীর্ঘমেয়াদী মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে। শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় বড় হয়, শিক্ষা পিছিয়ে যায়, স্থানীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এখনই মনোযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে এর প্রভাব অনেক গভীর হতে পারে।”
পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলও সরব হয়েছে। একাধিক বিরোধী নেতা এই হিংসা দমনে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও শাসক দলের দাবি, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এই অশান্তিকে উস্কে দিচ্ছে এবং সরকার কড়া হাতে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সব মিলিয়ে মুর্শিদাবাদে চলমান এই সহিংসতা ও তার পরিণতিতে তৈরি হওয়া মানবিক বিপর্যয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শান্তি কেবল আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়, বরং সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের প্রমাণ। আজকের এই ঘটনা যেন আরেকবার আমাদের প্রশ্ন করে—আমরা কেমন সমাজে বাস করছি, যেখানে একজন মানুষ নিজের রাজ্যেই নিরাপদ নন?
এই খবরের প্রতিটি ছবি, প্রতিটি সাক্ষাৎকার, প্রতিটি কান্না আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এটা কোনো সিনেমার গল্প নয়, এ আমাদের পাশের ঘরের মানুষের জীবনের বাস্তবতা। আমরা যদি আজ এগিয়ে না আসি, যদি আমরা এই গল্পটা তুলে না ধরি, তাহলে হয়তো আগামীকাল আমাদের গল্পও কেউ লিখবে না।