Thursday, April 17, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যইয়েমেনে মার্কিন হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি

ইয়েমেনে মার্কিন হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি

US attack in Yemen causes massive casualties:মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ ইয়েমেন, যার নাম শুনলেই মনে পড়ে যুদ্ধ, ধ্বংস আর শরণার্থী সঙ্কটের গল্প, আবারও খবরের শিরোনামে। আর এবার খবরটা আরও ভয়াবহ। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমেরিকার লাগাতার বিমান হামলায় ইয়েমেনে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১২৩ জন সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, আহত হয়েছেন আরও ২৪৭ জন, যাদের মধ্যে অনেকেই নারী ও শিশু। সানা প্রদেশের স্বাস্থ্য দফতরের তরফে দেওয়া এই তথ্য রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষকে। রবিবার সানার এক সিরামিক কারখানায় মার্কিন যুদ্ধবিমানের একটানা বোমাবর্ষণে মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের, আহত তিরিশ। ওই কারখানায় মূলত স্থানীয় শ্রমিকরাই কাজ করতেন, যাঁরা তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে শুধুই শোক, হাহাকার আর বাঁচার লড়াই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে হুথি গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিয়েছিলেন, সেই হুমকিই যেন রূপ নিচ্ছে বাস্তবের মাটিতে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লোহিত সাগরের শিপিং রুটকে সুরক্ষিত রাখতে, এবং হুথি বিদ্রোহীদের দমন করতেই এই অভিযান। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যারা মারা যাচ্ছে তারা কি শুধুই হুথি সদস্য? না, তারা সাধারণ মানুষ, ঘরের মেয়েরা, খেলার মাঠের শিশুরা, বাজারে সবজি বেচতে যাওয়া বাবা, অথবা মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া বয়স্ক মানুষ। সানার এক বাসিন্দা, ৪৫ বছরের ওমর নাজি বলছেন, “আমার ছোট ভাই সিরামিক ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। রবিবার সকালে ও কাজে গিয়েছিল, আর রাতে আমরা তার মৃতদেহ হাতে পেলাম। বোমা কি হুথি আর সাধারণ মানুষ আলাদা করে দেখে?” শুধু সিরামিক কারখানাই নয়, মার্কিন হামলায় ধ্বংস হয়েছে বহু সামরিক ভবন, কিন্তু তার পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে বহু মানুষের ঘরবাড়ি, রুটি-রুজি, এবং বিশ্বাস। শিশুরা আর রাতের ঘুম পায় না, কারণ আকাশে গর্জে ওঠা যুদ্ধবিমান তাদেরও বুক কাঁপিয়ে তোলে। এই হামলায় নিহত ইয়েমেনি সেনার সংখ্যাও কম নয়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেই সব পরিবার যারা রাজনীতি বোঝে না, কিন্তু যুদ্ধের বলি হয়ে যায় প্রতিদিন।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইয়েমেন আজ কার্যত একটি “ওয়ার জোন” হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যু আর আতঙ্ক যেন একমাত্র সঙ্গী। হুথি গোষ্ঠী পাল্টা জানিয়ে দিয়েছে—ইজরায়েল যদি গাজা থেকে হামলা না থামে, যদি ফিলিস্তিনের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায় সংহতি না জানায়, তাহলে হুথিদের সামরিক অভিযানও চলবে। এই ঘোষণা আরও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। কারণ, ইয়েমেন এখন শুধুই ইয়েমেনের সমস্যা নয়, এটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক কুয়াশাচ্ছন্ন লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থল। রেড সি’র নিরাপত্তা, ইরান-সৌদি প্রভাব, মার্কিন সামরিক আগ্রাসন এবং ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত—সব মিলিয়ে ইয়েমেন যেন এক চরম উত্তেজনার “জিওপলিটিক্যাল হটস্পট” হয়ে উঠেছে। আর এরই মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে স্থানীয় মানুষের আর্তনাদ। ইউএন এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছে এবং বলেছে, “যে কোনও সামরিক অভিযানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মানা উচিত। বেসামরিক মানুষ যাতে আক্রান্ত না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে।” কিন্তু এই ভাষ্য এখন শুধু কাগজে, বাস্তবের মাটিতে শিশুর কান্না আর মায়েদের আর্তনাদই একমাত্র সত্য। ইয়েমেনি চিকিৎসক দানি আল-মাজিদ জানিয়েছেন, “আমরা হাসপাতাল চালাতে পারছি না। রক্ত নেই, ওষুধ নেই, এমনকি অক্সিজেন নেই। প্রতিদিন মৃতদেহের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

yemen 1 20250317090850

গত তিন সপ্তাহে আমাদের হাসপাতালেই ৪০টি শিশু মারা গেছে।” পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, বহু পরিবার দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ, রাস্তায় বোমা, আকাশে ড্রোন—কোথায় যাবে তারা? আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে যুদ্ধ চললেও গত কয়েক মাসে হামলার সংখ্যা এবং তীব্রতা বেড়েছে বহু গুণে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা “আঞ্চলিক নিরাপত্তার নামে” যেভাবে এই এলাকায় হামলা চালাচ্ছে, তা মানবাধিকারের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন বলে দাবি করেছেন বহু মানবাধিকার সংস্থা। তাদের প্রশ্ন—একটি রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে যদি আরেক রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের জীবন এভাবে বলি দেওয়া হয়, তাহলে কাদের জন্য এই সুরক্ষা? কেন এই যুদ্ধের শেষ নেই? ইয়েমেনের রাজধানী সানার এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, “এই শহরে এখন আর সকাল-সন্ধ্যার পার্থক্য নেই। চারপাশে ধোঁয়া, বারুদের গন্ধ আর ক্ষয়িষ্ণু ভবন। কোনও মা নিশ্চিত হতে পারে না, তার সন্তান আগামীকাল স্কুলে যেতে পারবে কি না।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত কোনও দুঃখপ্রকাশ করেনি এই প্রাণহানির জন্য। বরং তারা জানিয়েছে, ‘হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরণের আগ্রাসন কেবল হুথিদেরই আরও কঠোর করে তুলবে। আর এই অবস্থার সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে—এর কোনও সমাপ্তির রূপরেখা নেই। কেউ জানে না যুদ্ধ কবে শেষ হবে, শান্তি কবে ফিরবে, শিশুরা কবে আবার নির্ভয়ে খেলবে। ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ এখন কেবল একটা প্রশ্ন করছেন—“আমরা কী দোষ করেছি?” যুদ্ধ কাদের জন্য, আর ক্ষতি কার? উত্তর কারো কাছে নেই। বিশ্ববাসী আজ যদি মুখ না খোলে, যদি এ অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়, তবে এই মৃত্যুমিছিল শুধু ইয়েমেনেই থামবে না, ছড়িয়ে পড়বে আরও অনেক দেশে। আর মানবতা হারিয়ে যাবে রক্ত আর ধ্বংসস্তূপের নিচে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments