Child dead at Contai: পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি শহর – এই শহর যেমন পরিচিত সমুদ্রের নোনতা হাওয়া আর উৎসবের রঙিন আবহে, তেমনই কাঁথি এখন শিরোনামে এসেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য। বসন্তিয়া গ্রামীণ হাসপাতালের গাফিলতির অভিযোগ তুলে এক শিশুকন্যার মৃত্যু ঘিরে যে কষ্ট, তা শুধু একটা পরিবারের নয়, গোটা সমাজের এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মঙ্গলবার রাত প্রায় বারোটার সময়, ছয় বছরের এক শিশুকন্যাকে তার মা অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসেন বসন্তিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে। শরীরে জ্বর, বমি আর দুর্বলতা—এইসব উপসর্গ নিয়ে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে। মা জানিয়েছেন, “ডাক্তারবাবুরা একটা ইনজেকশন দিয়ে বললেন, কিছু হয়নি, বাড়ি নিয়ে যান। কিন্তু মেয়ের শরীর তো ঠিক হচ্ছিল না। বরং আরও খারাপ হতে থাকে।” তখনই আবার শিশুটিকে হাসপাতালে আনা হয়।
চিকিৎসকদের তরফে জানানো হয়, তখন তাঁরা শিশুটিকে পুনরায় পরীক্ষা করে হাতে চ্যানেল করে কয়েকটি ইনজেকশন দেন। কিন্তু এরপরেই শিশুটির অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সেই মুহূর্তে পরিবারের বুক ফাটা কান্না হাসপাতালের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। রাগ, দুঃখ আর অসহায়তা একত্রিত হয়ে যেন আগুন হয়ে ফেটে পড়ে। বুধবার সকালেও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। হাসপাতালের বাইরে জড়ো হয় মৃত শিশুর পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় মানুষজন। গাফিলতির অভিযোগ তুলে তারা ঘেরাও করেন হাসপাতাল, শুরু হয় উত্তেজনা। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কাঁথি থানার পুলিশ আধিকারিকেরা বহু বোঝানোর পরেও পরিস্থিতি শান্ত হতে সময় লাগে।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ কি শিশু চিকিৎসায় পর্যাপ্ত পরিকাঠামো আছে বসন্তিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে? নাকি বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসকেরা বেসরকারি চেম্বারে বেশি সময় দিয়ে থাকেন, আর সাধারণ মানুষের ভরসা হয়ে ওঠা এই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা যেন চলছে ভাগ্যের উপর নির্ভর করে? স্থানীয় বাসিন্দা প্রশান্ত জানার ক্ষোভ, “এটা প্রথম নয়। এই হাসপাতালে আগে অনেকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেউ শাস্তি পায়নি। এবার যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?” হাসপাতালের এক অপ্রকাশিত চিকিৎসক জানান, “আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। শিশুটির অবস্থাই এমন ছিল যে কিছু করার ছিল না। তবে সমস্ত ঘটনা নিয়ে তদন্ত হবে বলেই শুনছি।”
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে কাঁথি শহরের সাধারণ মানুষের মনে যেমন আতঙ্ক ও ক্ষোভ জমছে, তেমনি সমাজের অনেক স্তরের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে—এখনও কি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা এতটাই ভঙ্গুর যে এক শিশুর প্রাণও বাঁচানো যায় না? বসন্তিয়া হাসপাতাল হল কাঁথি ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এই অঞ্চলের হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এখানে নির্ভর করেন। কাঁথির আশপাশে মহিষাদল, তমলুক, খেজুরি কিংবা রামনগরের মতন এলাকা থেকে রেফার করা রোগীরাও এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু পরিকাঠামোগত সমস্যা, পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্সের অভাব, এবং ওষুধপত্র বা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে বহুক্ষেত্রেই চিকিৎসার গাফিলতি সামনে আসে।
মঙ্গলবার রাতের এই ঘটনায় শিশুটির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় সমাজকর্মীরাও। সমাজকর্মী সুমিত্রা দাস বলেন, “শিশুদের জন্য আলাদা মেডিকেল টিম থাকা দরকার। আমরা চাই রাজ্য সরকার এই বিষয়ে নজর দিক।” স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যরাও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে বিস্তারিত তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। কাঁথির বিধায়ক অরুণ কুমার জানিয়েছেন, “ঘটনাটি দুঃখজনক। পরিবারটির সঙ্গে আমার সহানুভূতি আছে। আমি স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছি। দোষী কেউ থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই মুহূর্তে শিশুটির শোকস্তব্ধ পরিবার প্রশ্ন তুলেছে, “যদি ঠিকমতো চিকিৎসা হতো, তাহলে কি আমাদের মেয়ে বাঁচত না?” এই প্রশ্নের উত্তর শুধু একজন ডাক্তার নয়, আমাদের গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাছেই। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আর চিকিৎসার প্রাপ্যতা যদি এতটাই দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে উন্নয়নের গল্প কতটুকু সত্যি?
এই ঘটনাটি যেন আরেকটি নমুনা হয়ে রইল কিভাবে কাঁথির মতো শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজও উন্নয়নের অপেক্ষায়। শিশুদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ইউনিট, নিরবচ্ছিন্ন ওয়াচিং, এবং ডাক্তার-নার্সদের পর্যাপ্ত উপস্থিতি না থাকলে ভবিষ্যতে এমন আরও ঘটনা ঘটতে পারে, যা সমাজকে আরও অসহায় করে তুলবে। প্রশাসনের উচিত এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সঠিক তদন্ত করা এবং জনগণের ভরসা ফিরিয়ে আনা। না হলে, “সরকারি হাসপাতাল” শব্দটা শুধুই কাগজে-কলমে থেকে যাবে।
এই ঘটনা শুধু বসন্তিয়ার নয়, গোটা কাঁথির একটা সতর্ক সংকেত। আমাদের প্রত্যেকের প্রশ্ন জাগে—আমাদের সন্তানরা কি নিরাপদ? সরকারি হাসপাতাল কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? উত্তর সময় দেবে, তবে এই সময়ে দরকার মানুষের আওয়াজ, ন্যায়ের দাবি আর মানবিকতার সুরক্ষা।