Guntrial Rana, new metro route on April 24 :কলকাতার বুক চিরে আবারও এক নতুন দিনের সূচনা হতে চলেছে—শহরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন সত্যি করে অবশেষে চলতি মাসের ২৪ তারিখে উদ্বোধন হতে পারে একাধিক মেট্রো প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হল হাওড়া ময়দান থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো পথ, যার শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড অংশটিতে বর্তমানে চলছে ট্রায়াল রান। বহু বাধা-বিপত্তি, ভয়ঙ্কর সুড়ঙ্গ দুর্ঘটনা, টানেল ধস, এবং প্রকল্প বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা পেরিয়ে এই প্রকল্প আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, তা নিঃসন্দেহে বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের মুহূর্ত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে আসার সম্ভাবনার মধ্যেই শোনা যাচ্ছে, তিনি এই প্রকল্পগুলির এক বা একাধিকটির উদ্বোধন করতে পারেন। যদিও রেল মন্ত্রক এখনো স্পষ্ট করে জানায়নি তিনি কোন প্রকল্পের ফিতে কাটবেন, তবে ইঙ্গিত মিলছে যে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর পূর্ণাঙ্গ পথ, অর্থাৎ হাওড়া ময়দান থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত অংশটি শিগগিরই সাধারণ যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে।

তবে একটা অংশ এখনো অগ্নি নিরাপত্তার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে, বিশেষ করে শিয়ালদহ-এসপ্ল্যানেডের মধ্যবর্তী অংশটি, যেখানে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের পর কাজ প্রায় থেমে গিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, এই অংশটির কাজ নিয়ে বহুবার উঠে এসেছে সংশয়—বউবাজারের নিচে সুড়ঙ্গ খননের সময় ধস নামায় বহু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরিবারগুলোকে হোটেলে ঠাঁই নিতে হয়, আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যেই দিন কেটেছে বহু মানুষের। সেই রাতগুলোর কথা এখনও যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে শহরের হৃদয়ে। তবু থেমে থাকেনি কাজ। মেট্রো কর্তৃপক্ষ, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক—সকলের অক্লান্ত পরিশ্রমে পুনরায় গতি পায় প্রকল্প। এখন ট্রায়াল রানে প্রতিদিন মেট্রো দৌড়চ্ছে শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে নজর রাখা হচ্ছে যান্ত্রিক নিরাপত্তা, জরুরি প্রতিক্রিয়া, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, এবং যাত্রী নিরাপত্তার উপর। মেট্রো সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি (CRS) এই পথে পরিদর্শনে আসবেন। যদি তাঁরা সবুজ সংকেত দেন, তাহলে এপ্রিলের শেষে বা মে মাসের শুরুতেই পুরো পথ চালু করা যেতে পারে।
এই মেট্রো পথ চালু হলে প্রথমবারের মতো দুটি নদীর নিচ দিয়ে যাত্রীবাহী রেল চলবে—হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা গঙ্গার নিচ দিয়ে শিয়ালদহ হয়ে সল্টলেক পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে মাত্র ২৭ মিনিটে! শহরের দুই প্রান্ত হাওড়া ও সেক্টর ফাইভ একসূত্রে বাঁধা পড়বে, আর এতে করে ট্র্যাফিকের চাপ অনেকটাই কমবে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। হাওড়া থেকে অফিস টাইমে সেক্টর ফাইভ পৌঁছাতে যেখানে এখন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে মেট্রো ধরলে আধ ঘণ্টার কমে কাজ সেরে নেওয়া যাবে। ছোট ব্যবসায়ী, অফিসযাত্রী, ছাত্রছাত্রী, এমনকি পর্যটকরাও এই নতুন মেট্রো পথের সুবিধা ভোগ করবেন বলে আশা। মেট্রো নির্মাণে যুক্ত থাকা এক ইঞ্জিনিয়ার আনন্দ ভট্টাচার্য বলেন, “এই সুড়ঙ্গ তৈরি করতে আমাদের যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু আজ যখন দেখি ট্রায়াল রানে মেট্রো ছুটছে, তখন মনে হয় পরিশ্রম সার্থক।” বউবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দা শ্রীমতি অনুরাধা দে জানালেন, “আমরা ভেবেছিলাম, এই প্রকল্প আর শেষ হবে না। আমাদের বাড়ি ভেঙে পড়েছিল, আমরা আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি। এখন আবার নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।” শুধু কলকাতা নয়, সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জন্য এই মেট্রো পথ হতে চলেছে এক যুগান্তকারী উন্নয়নের দিশা।
মেট্রোর মাধ্যমে শহরের ভেতরে দ্রুতগামী, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থার একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশবিদ রমেশ গুহর মতে, “মেট্রো ব্যবস্থার সম্প্রসারণ মানে শুধু যাতায়াত নয়, শহরের বায়ু দূষণ কমানোতেও বড় অবদান রাখতে পারে। গাড়ির সংখ্যা কমবে, কার্বন নির্গমন কমবে।” প্রধানমন্ত্রী মোদীর সম্ভাব্য সফর ঘিরে রাজনৈতিক মহলেও চলছে জোর প্রস্তুতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক রেল প্রকল্পে রাজ্যের অবদান স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং আশা প্রকাশ করেছেন, রাজ্য ও কেন্দ্র একসঙ্গে কাজ করলে এমন অনেক প্রকল্প দ্রুত সম্পূর্ণ হবে। তবে সাধারণ মানুষের চোখ এখন একটি দিকেই—কবে মেট্রোর দরজা খুলবে? কবে তারা চেপে বসবে সেই বহু প্রতীক্ষিত গঙ্গার নিচের সুড়ঙ্গপথে চলা মেট্রোয়? আর মাত্র কয়েকটি দিন, হয়তো কয়েকটি অনুমতি, তারপরই খুলে যাবে সেই স্বপ্নের দরজা। কলকাতার হৃদয়ে বেজে উঠবে মেট্রোর নতুন সুর।