Marathon run in Raniganj under the initiative of ‘Look Back and See’ : ১৩ই এপ্রিল, রবিবার, রানীগঞ্জ শহরের সকালটা যেন একেবারে অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। শহরের হাওয়ায় তখন শুধুই উদ্দীপনা, আবেগ আর সচেতনতার মিশ্র ধ্বনি। শিশু বাগান ফুটবল ময়দানের সামনে মানুষের ঢল, গায়ে নম্বর প্লেট লাগানো দৌড়বিদরা, কানে হেডফোন, চোখেমুখে তীব্র আত্মবিশ্বাস, আর পাশে উৎসাহী দর্শকদের করতালিতে ভরে উঠেছিল গোটা এলাকা। ‘ফিরে দেখো প্রতীতি’ ওয়েলফেয়ার সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত এই ৫ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র একটিই—সুস্থ সমাজ গঠন ও ক্যান্সার বিরোধী সচেতনতা। আর এই উদ্দেশ্য যে কেবলমাত্র কথার কথা নয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো রানীগঞ্জবাসী। প্রত্যেক বছরই ফিরে দেখো প্রতীতি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ মূলক কাজ করে থাকে—কখনও রক্তদান শিবির, কখনও পথশিশুদের জন্য শিক্ষা প্রকল্প, আবার কখনও স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির। আর এ বছরের শুরুতেই তারা যে এমন একটি ম্যারাথনের আয়োজন করেছে, তাতে গোটা শহরের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। এদিন প্রায় ৫০০ জন পুরুষ ও মহিলা দৌড়বিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন এই ম্যারাথনে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই এসেছিলেন জেলা বা রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে। সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ জড়ো হতে থাকেন শিশু বাগান চত্বরে। রানীগঞ্জ অ্যাথলেটিক্স জাজেরা ছিলেন পুরো দৌড়টির সফল পরিচালনায়—দৌড়ের পথ নিরাপদ রাখা, সময় নির্ধারণ, ফলাফল ঘোষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁরা যে নিখুঁতভাবে কাজ করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য তাঁদের।
উপস্থিত ছিলেন রানীগঞ্জের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা এমএমআইসি দিব্যেন্দু ভগত, যিনি নিজেও হাঁটলেন প্রতীকি ভাবে ম্যারাথনের একাংশ। তিনি জানান, “এই দৌড় কেবল একটি প্রতিযোগিতা নয়, এটি হল একটি বার্তা—আমরা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ছি, আমরা সুস্থ থাকতে চাই, সুস্থ সমাজ গড়তে চাই।” তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সানাকা হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডঃ রাজীব সেন, যিনি জানান, “আজকের এই দৌড় শুধু শরীরচর্চা নয়, এটি এক মনোভাব, এটি আমাদের ভিতর থেকে বাঁচার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে। ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য শরীরচর্চা, পুষ্টিকর খাবার, ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ভীষণ জরুরি। এই ম্যারাথন সেই বার্তাই ছড়িয়ে দিলো।” ফিরে দেখো প্রতীতির অন্যতম উদ্যোক্তা মিতালী বসু বলেন, “আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের শরীরের যত্ন নিক, নিজের চারপাশের মানুষদেরও সচেতন করুক। সমাজকল্যাণের জন্য আমরা প্রতি বছরই নতুন কিছু করার চেষ্টা করি, আর এই ম্যারাথনের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম যে মানুষ পাশে থাকলে সবকিছু সম্ভব।”
এই দৌড়ে পুরুষদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন সন্তোষ কুমার যাদব, যিনি পেশায় একজন কোচ এবং গত চার বছর ধরেই বিভিন্ন ম্যারাথনে অংশ নিচ্ছেন। “এই রকম উদ্দেশ্য নিয়ে দৌড়তে পারাটা আমার কাছে বড় পাওয়া,” বললেন সন্তোষ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন শুভদীপ গড়াই ও প্রশান্ত দাস, যাঁদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। মহিলা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন একতা গুপ্তা, যিনি নিজেই একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং নিজের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত শরীরচর্চার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন প্রিয়া লোহার ও ঈষিতা ঘোষ—দুজনেই রানীগঞ্জের স্থানীয় কলেজের ছাত্রী এবং ভবিষ্যতে খেলাধুলার জগতেই নিজেকে গড়ে তুলতে চান।

রানীগঞ্জের মানুষের কাছে এই অনুষ্ঠান ছিল এক বিশাল উৎসবের মতো। শুধুমাত্র দৌড়বিদরাই নয়, তাঁদের পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীরা এসেছিলেন সমর্থন জানাতে। কেউ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ‘সুস্থ থাকো, সচেতন থাকো’ বলছেন, কেউ আবার স্রেফ করতালিতে উৎসাহ যোগাচ্ছেন। দৌড় শেষে আয়োজকদের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারী সকলকে সার্টিফিকেট ও মেডেল দেওয়া হয়। এছাড়াও, উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লিফলেট বিতরণ করা হয় এবং সানাকা হাসপাতালের পক্ষ থেকে একটি ফ্রি হেলথ চেকআপ ক্যাম্পও বসে মাঠের একপাশে। সবমিলিয়ে শহরের মানুষ একদিনের জন্য হলেও যেন ভুলে গেলেন রোজকার ব্যস্ততা, ক্লান্তি আর উদ্বেগ।
এই ধরনের উদ্যোগ যে শুধুমাত্র এক দিনের ঘটনা হয়ে থাকলে চলবে না, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ফিরে দেখো প্রতীতি’ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে আগামী দিনে তারা আরও বড় পরিসরে এই দৌড় আয়োজন করবে—রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতার পাশাপাশি স্কুল ও কলেজ স্তরেও দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। পাশাপাশি, ক্যান্সার সচেতনতা নিয়ে নিয়মিত সেমিনার ও স্বাস্থ্য ক্যাম্প করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। সমাজে সুস্থতা, স্বচ্ছতা আর সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁদের মূল লক্ষ্য। রানীগঞ্জের এই ম্যারাথনের মাধ্যমে শহরবাসী বুঝিয়ে দিলো—মানুষ একসাথে থাকলে, ভালো কিছু করতেই পারে। শুধু প্রয়োজন সৎ ইচ্ছা, আর একটু সাহস।