Sunday, April 13, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জুড়ে রংবাহারি ছবি মুগ্ধ সকলেই

বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জুড়ে রংবাহারি ছবি মুগ্ধ সকলেই

Everyone is impressed by the colorful pictures across the school campus : পূর্ব বর্ধমানের বর্ধমান ২ নম্বর ব্লকের শক্তিগড় থানার অন্তর্গত ছোট্ট, শান্ত গ্রামের নাম বড়শুল, আর সেখানেই রয়েছে একটি সাধারণ সরকারি স্কুল—বড়শুল নিম্ন বুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু এই স্কুল এখন আর শুধুমাত্র পাঠদানের একটি কেন্দ্র নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক অভিনব শিল্পগাঁথার আখড়া। কারণ, সম্প্রতি এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়ালে ফুটে উঠেছে এমন কিছু রংবাহারি চিত্রকর্ম, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, মন আনন্দে ভরে ওঠে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই যেন মনে হয়, কেউ যেন রঙের জাদু ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। স্কুলের দালান নয়, যেন ছোট্ট এক শিল্পশালা। দেওয়ালে ফুটে উঠেছে নানান বিষয়—পরিবেশ শিক্ষা, দেশপ্রেম, সামাজিক বার্তা, জীববৈচিত্র্য, ভারতের ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি, এবং এমনকি শিশুদের জন্য মনোমুগ্ধকর কার্টুন চরিত্রও। এই চিত্রগুলোর মধ্যে যেমন শিক্ষামূলক বার্তা রয়েছে, তেমনই রয়েছে দৃষ্টিনন্দনতা ও সৃজনশীলতার অপূর্ব প্রকাশ।

এই উদ্যোগের পিছনে রয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঘোষ এবং তাঁর সহযোগী শিক্ষকদের উদ্যম। তাঁরা মনে করেন, শিশুদের শেখার পরিবেশ যদি আনন্দদায়ক না হয়, তবে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় না। তাই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে প্রাণবন্ত করে তোলার এই ভাবনাটি এসেছে বিদ্যালয় থেকেই। তাঁরা জানান, “আমরা শুধু বই পড়িয়ে শিক্ষাদান করতে চাই না, আমরা চাই বাচ্চারা স্কুলে এসে হাসিমুখে সময় কাটাক। আমরা চাই ওরা রঙের মধ্যে বেড়ে উঠুক, ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকুক।”

2Q==

এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় শিল্পী সুমন পাল এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তাঁরা কেউ পেশাদার শিল্পী, কেউ আবার নেশা থেকে রঙ তুলিতে ডুবে থাকা মানুষ। তাঁরা সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে একটার পর একটা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন স্কুলের দেওয়ালে। সুমন বলছিলেন, “এটা শুধু ছবি আঁকার কাজ না, এটা একটা সামাজিক দায়িত্ব। আমরা চাই গ্রামের বাচ্চারাও শহরের মতো সুন্দর পরিবেশে পড়াশোনা করুক।”এই উদ্যোগে স্কুল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সহায়তা করেছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য অঞ্জলি মণ্ডল, যিনি জানালেন, “স্কুল যদি সুন্দর হয়, পরিবেশ যদি প্রাণবন্ত হয়, তবে শুধু ছাত্র নয়, অভিভাবকরাও সন্তুষ্ট থাকেন। আমরা চাই এমন ভাবনা আরও বিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ুক।”

এই বিদ্যালয়ে মোট ১১৫ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে, যাঁদের বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। অনেকেই দিনমজুরের সন্তান, কৃষকের ঘরের ছেলে-মেয়ে। তাঁরা হয়তো কখনও শহরের কোনো আর্ট গ্যালারিতে যাবে না, কিন্তু আজ তাঁদের স্কুলেই রয়েছে সেই অনুভব। এই পরিবর্তন শুধু চেহারার নয়, মনেরও। শিক্ষকদের মতে, এই নতুন রঙিন পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি অনেক বেড়েছে, পড়াশোনায় মনোযোগ বেড়েছে, এবং স্কুলে আসার আগ্রহও অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী মেঘা বলল, “আগে স্কুলটা সাদা ছিল, ভালো লাগত না। এখন স্কুলে আসলে মনে হয় কার্টুনের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছি।” তার মতোই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র শুভম জানায়, “দেওয়ালে এখন নেতাজির ছবি আছে, আমি রোজ স্কুলে এসে সেলুট দিই। মনে হয় আমিও বড় হয়ে কিছু করব দেশের জন্য।”

এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় মানুষের মনেও। আগে যাঁরা সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো নিয়ে অভিযোগ করতেন, এখন তাঁরা নিজেরাই সন্তানদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করাতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। অভিভাবক রাধাকান্ত মণ্ডল বলেন, “আগে মনে হত প্রাইভেট স্কুলেই ভালো শিক্ষা হয়, কিন্তু এখন আমাদের বড়শুল স্কুলটাকেই সবচেয়ে ভালো লাগছে। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার পরিবেশও তো দরকার।”এই অভিনব উদ্যোগ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে—শিক্ষা মানেই শুধু বই নয়, শিক্ষা মানে চিন্তা, সৃজনশীলতা, অনুভব। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের এই চেষ্টার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, একটু উদ্যোগ, একটু মনোভাবনা থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়ে না। বরং নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা সামনে চলে আসতে পারে।

এই স্কুলের এই রঙিন রূপান্তর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের গতিতে। অনেকেই ছবি পোস্ট করে বলছেন, “এই স্কুলটা যেন গ্রামের গর্ব।” কেউ আবার মন্তব্য করেছেন, “এই শিক্ষকদের ধন্যবাদ, যাঁরা স্কুলকে শুধু পাঠের জায়গা নয়, ভালোবাসার জায়গা বানিয়েছেন।”এই উদ্যোগ এখন অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে আশপাশের অন্যান্য বিদ্যালয়ের জন্যও। বর্ধমানের আরও কয়েকটি সরকারি বিদ্যালয় এই ধাঁচে নিজেদের বিদ্যালয়ে দেওয়ালচিত্র আঁকার পরিকল্পনা শুরু করেছে। জেলা শিক্ষা আধিকারিক অমিতাভ সেনগুপ্ত জানান, “আমরা চাই প্রতিটি বিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ভাবনা নিয়ে উঠে আসুক। বড়শুল স্কুল সেটার অনন্য দৃষ্টান্ত। জেলা প্রশাসন থেকে আমরা এই ধরনের উদ্যোগে সব রকম সাহায্য করব।”এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে দিল, সুন্দর চিন্তা আর নিবেদিতপ্রাণ কিছু মানুষের ইচ্ছা থাকলে যেকোনো সাধারণ বিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। বড়শুল নিম্ন বুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই রঙিন স্বপ্ন যেন দেশের সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, আর যেন প্রতিটি শিশু তাদের বিদ্যালয়কে ভালোবাসে, ঠিক যেমন তারা ভালোবাসে খেলনা বা কার্টুনকে। এই ভালোবাসাই হয়তো আগামী দিনের ভারত গঠনের ভিত তৈরি করবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments