Six processions in Dhupguri on Hanuman Jayanti:ধূপগুড়ি শহর যেন একদিনের জন্য রূপ নিয়েছিল ভক্তিভাবনায় রাঙানো এক মহোৎসবের মঞ্চে—অভিনব রূপে, উৎসবের ছোঁয়ায় এবং মানুষের ঢল-ঢোল বাঁশির ছন্দে। প্রতিবছরের মতো এবারও হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে ধূপগুড়ির গয়েরকাটা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী হনুমান মন্দির চত্বরে আয়োজিত হল এক বিশাল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান, যা সকাল থেকেই ধূপগুড়ির আকাশ বাতাসকে ভরে তুলেছিল ভক্তি, ধর্মীয় গান, ঢাকের শব্দ আর নানা রঙে সাজানো মানুষে মানুষে। মন্দির কমিটির তরফ থেকে আয়োজন করা এই অনুষ্ঠানে সকাল থেকেই নানা ধর্মীয় রীতি, পূজা-পাঠ, প্রসাদ বিতরণ ও সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে শুভ সূচনা হয়, আর তার পরে যেটা শহরবাসীর নজর কেড়ে নেয়, সেটা হলো সেই বিশাল শোভাযাত্রা যা মিছিলের আকারে শহর পরিক্রমা করে গয়েরকাটা বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে ঘোষপাড়া মোড় হয়ে ধূপগুড়ি চৌপথি পর্যন্ত পৌঁছায়, যেখানে এক মহাসমাপ্তি হয় ধর্ম আর ভক্তির জয়গানে। শোভাযাত্রায় ছিল এক বিশাল আকৃতির হনুমান মূর্তি, সঙ্গে ছিল রাম, লক্ষ্মণ, সীতা ও হনুমানের সাজে নৃত্যগোষ্ঠীর শিল্পীরা যারা ধর্মীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পথে পথে ভক্তদের মন জয় করে নেন। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই দিনটি যেন হয়ে ওঠে এক জীবন্ত পৌরাণিক চরিত্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার দুর্লভ সুযোগ। এক হাতে গদা, অন্য হাতে পাহাড় তুলে ধরা হনুমান মূর্তিটি দেখতে ভিড় জমিয়েছিল চারপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা সকাল থেকে শহরে এসে জড়ো হয়েছিলেন এই বিরল আয়োজন
প্রত্যক্ষ করতে। শোভাযাত্রার সামনের সারিতে দেখা যায় ধূপগুড়ি পুরসভার বোর্ড অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ভাইস চেয়ারম্যান রাজেশ কুমার সিং, ধূপগুড়ির বিধায়ক নির্মল চন্দ্র রায়, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ মমতা সরকার বৈদ্য, প্রাক্তন কাউন্সিলর নূরজাহান বেগম সহ বহু বিশিষ্টজনকে। তাঁদের মতে, “এই ধরনের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুধু ধর্মীয় আবেগ নয়, মানুষকে একত্রিত করার একটা বড় মাধ্যমও।” ধূপগুড়ি বিধায়ক নির্মল বাবু বললেন, “এটা শুধু একটা ধর্মীয় মিছিল নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। ছোট থেকে বড়, হিন্দু থেকে মুসলিম—সবার অংশগ্রহণ এই শহরের সম্প্রীতির বার্তা দেয়।” নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ধূপগুড়ি থানার তরফ থেকেও নেওয়া হয়েছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শহরের প্রধান মোড়, ব্যস্ত রাস্তা ও মন্দির চত্বরে মোতায়েন ছিল প্রচুর পুলিশ বাহিনী, যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি না ঘটে। শিশু ও প্রবীণ দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা সহায়ক কেন্দ্র ও পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় দোকানপাট ও ব্যবসায়ীরাও অংশ নেন এই উৎসবে, অনেক দোকানদার দিনভর প্রসাদ বিতরণ করেন এবং অনেকেই মিছিলের পথে পথের পাশে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের জন্য ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা করেন। ধূপগুড়ি শহরের বহু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে অংশ নেয় এই শোভাযাত্রায়, অনেকে আবার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহায্যও করে অনুষ্ঠানের সুন্দর সমাপ্তিতে। শুধু ধূপগুড়ি নয়, আশেপাশের অঞ্চল থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় জমান এই অনন্য অনুষ্ঠান উপভোগ করতে, ফলে শহরের হোটেল, লজ, খাবারের দোকানেও চোখে পড়ে বিশেষ ভিড়, যার ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ধরনের বৃহৎ উৎসব কেবল ধর্মীয় আবেগে ভরপুর নয়, বরং তা এক সামাজিক বন্ধনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। এই উৎসবের ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান রাজেশ কুমার সিং বলেন, “প্রতি বছর আমরা চেষ্টায় থাকি এই অনুষ্ঠান আরও সুন্দরভাবে করার। আগামী বছর থেকে আমরা চাই এই উৎসব রাজ্যস্তরে পরিচিতি পাক। পর্যটকদের আকৃষ্ট করাও আমাদের লক্ষ্য।” অন্যদিকে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী উত্তম দাস জানালেন, “এই অনুষ্ঠান শহরের ব্যবসার পক্ষে দারুণ লাভজনক। মিছিল মানেই প্রচুর মানুষ, প্রচুর বিক্রি।” তবে এই উন্মাদনার মাঝে কিছু সমস্যা যেমন ট্র্যাফিক জ্যাম, শব্দদূষণও ধরা পড়ে, যা স্থানীয়দের একটু অসুবিধায় ফেলে। বিশেষ করে প্রবীণ ও শিশুদের জন্য কিছু এলাকায় অতিরিক্ত ভিড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে প্রশাসনের তৎপরতায় বড় কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। সামগ্রিকভাবে বললে, এই হনুমান জয়ন্তী যেন ধূপগুড়ি শহরের এক নতুন চেহারা এনে দিল—যেখানে ধর্মীয় আবেগ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্প্রীতি আর ভক্তিভাবনা মিলে মিশে তৈরি করল এক অবিস্মরণীয় দিনের গল্প।