Saturday, April 12, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যশেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রেজ্জাক মোল্লা

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রেজ্জাক মোল্লা

Rezzak Molla breathed his last:রাজনীতির মঞ্চে যিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন “চাষার ব্যাটা” বলে, যিনি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য রাজনীতিতে নিজস্ব একটা শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন, সেই রেজ্জাক মোল্লা আজ আর নেই—এই খবর শুক্রবার সকাল থেকেই ভাঙড় থেকে গোটা রাজ্য জুড়ে এক অনুশোচনার আবহ তৈরি করেছে। ৮০ বছর বয়সে, নিজের জন্মস্থান দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের বাকড়ি গ্রামে অবস্থিত বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। শেষ কয়েক বছর কার্যত রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে নিঃশব্দ জীবন যাপন করলেও, তাঁর মৃত্যু যেন রাজনীতির মঞ্চে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে গেল, যা সহজে পূরণ হবার নয়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের উত্থানের সময় রাজনীতিতে পা রাখা রেজ্জাক ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্র থেকে বারবার জিতে এসেছেন বিধানসভায়, বামফ্রন্ট সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই আসনের বিধায়ক ছিলেন। বামফ্রন্ট যখন রাজ্যে একের পর এক দুর্গ হারাচ্ছে, তখনও রেজ্জাক মোল্লার এই আসন ছিল অটুট। দীর্ঘ সময় তিনি ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের দায়িত্ব সামলেছেন, সিপিএম সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে। তবে রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় বাঁক আসে ২০১৪ সালে, যখন সিপিএম রাজ্য কমিটি তাঁকে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে বহিষ্কার করে। সেই ঘটনার পরে তিনি নিজেই এক নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন—‘ভারতীয় ন্যায়বিচার পার্টি’। তখন থেকেই তিনি বলতেন, “আমি চাষার ব্যাটা, আমি চাষির কথা বলব, কৃষকের জন্য রাজনীতি করব।” যদিও সেই দল খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি, পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূলে যোগ দিয়ে তিনি আবার বিধায়ক হন, এইবার ভাঙড় কেন্দ্র থেকে। সেই সরকারের আমলে খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তরের দায়িত্বও পান তিনি। কিন্তু বয়সজনিত কারণে ২০২১ সালে আর তাঁকে প্রার্থী করেনি তৃণমূল, এবং সেখান থেকেই তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। শেষ কয়েক বছর ছিলেন কার্যত জনজীবন থেকে দূরে, একান্তে, অসুস্থ শরীর নিয়ে গৃহবন্দি অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছেন সময়। তবে মাঝেমধ্যে কিছু রাজনৈতিক ইস্যুতে তাঁর মন্তব্য উঠে এসেছে শিরোনামে, যা প্রমাণ করে তিনি রাজনীতির প্রতি কতটা নিবেদিত ছিলেন অন্তর থেকে। রেজ্জাক মোল্লার মৃত্যু সংবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে শোকপ্রকাশ করে লিখেছেন, “একসময় অন্য ধারার রাজনীতি করলেও, মা-মাটি-মানুষের সরকারে তাঁর মিলিত হয়ে যাওয়া ছিল সহজ ও স্বাভাবিক।” শুধু মুখ্যমন্ত্রীই নয়, সিপিএম, তৃণমূল থেকে বিজেপি—সব রাজনৈতিক দল থেকেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “দল থেকে দূরে থাকলেও, রেজ্জাক মোল্লা ছিলেন আমাদের এক শক্ত ঘাঁটির প্রতীক। তাঁর মৃত্যুতে রাজনীতির এক যুগের অবসান ঘটল।” ভাঙড়ের মানুষের কাছে রেজ্জাক ছিলেন এক পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, “উনি শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ওনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। গরিব মানুষদের পাশে ওনাকে সব সময় পাওয়া যেত।” এমনকি রেজ্জাক মোল্লার নিজের রাজনৈতিক পরিচয়েও একটি আলাদা স্পর্শ ছিল। তিনি বলতেন, “আমি চাষার ব্যাটা, আমি রাজনীতি করি মাটির কাছাকাছি থেকে।” রাজনীতিতে যখন জটিলতা, দুর্নীতি আর তোষণ নীতির অভিযোগে বহু নেতা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন রেজ্জাক মোল্লার মতো একজন সরল, স্পষ্টভাষী ও নির্ভীক নেতার অভাব আগামী প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত বর্তমান রাজনীতিবিদদের, যাঁরা প্রায়শই ক্ষমতার মোহে নীতির প্রশ্নে আপস করেন। রেজ্জাক মোল্লার মৃত্যু কেবল একজন প্রাক্তন মন্ত্রীর মৃত্যু নয়, এটি এক দর্শনের মৃত্যু, এক জীবনবোধের সমাপ্তি, এক কর্মনিষ্ঠ রাজনীতির অধ্যায়ের অবসান। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা থাকবে সেই মানুষদের পাশে, যারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য রাজনীতি করেছে। ভাঙড়, ক্যানিং, দক্ষিণ ২৪ পরগনা তো বটেই, গোটা বাংলা আজ শোকস্তব্ধ। এবং এ শোক কেবল রাজনীতির নয়, এটা এক মননশীল, মাটির কাছাকাছি থাকা, সাধারণ মানুষের রাজনীতির প্রতি ভালোবাসার মানুষটির বিদায়। শেষকৃত্য নিয়ে এখনো কোনও সরকারিভাবে ঘোষণা না হলেও পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বাকড়ির পারিবারিক কবরস্থানেই দাফন করা হবে তাঁর দেহ। রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, আগামী দিনে হয়তো ভাঙড়ে তাঁর নামে স্থাপিত হবে কোনও স্মৃতিসৌধ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যাতে নতুন প্রজন্ম রেজ্জাক মোল্লার মতো নেতার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে। তাঁর জীবন এক প্রেরণা—যেখানে সাধারন কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও শুধুমাত্র কাজ আর সততার উপর ভরসা রেখে এক দীর্ঘ, গর্বিত রাজনৈতিক পথ চলা সম্ভব। এমন মানুষ কখনো মরে না, তাঁরা ইতিহাসে বেঁচে থাকেন চিরকাল

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments