পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারী থানার অন্তর্গত ছোট্ট শান্ত গ্রাম কালশি, যেখানে দিনের শুরু হয় পাখির ডাক আর গাছের ছায়ায় শান্তি খোঁজে সাধারণ মানুষ, সেই গ্রামেই হঠাৎ করে এক ভোরবেলার ঘটনা ঘুম কেড়ে নিয়েছে অনেকের চোখ থেকে। অভিযোগ, সরকারি জায়গায় থাকা বহু পুরনো ছাতিম গাছ বেআইনিভাবে কেটে ফেলা হয়েছে একজন ব্যক্তির দ্বারা, যাঁর নাম রবিশঙ্কর দত্ত। এই গাছ দুটি ছিল কালশি মোড় থেকে শুড়ো দুর্গাপুর যাবার রাস্তায়, ঠিক ওই ব্যক্তির বাড়ির সামনেই। এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন, আগেও তিনি এই গাছ কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তখন স্থানীয়দের প্রতিবাদে গাছ কাটা বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু এইবার তিনি নতুন কৌশলে এগিয়ে যান—

দিন না উঠতেই, লোকচক্ষুর আড়ালে শুরু করে দেন গাছ কাটার কাজ। স্থানীয় মানুষজন যখন শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন, তখন একটি ছাতিম গাছ ইতিমধ্যেই পড়ে গিয়েছে এবং গাছ কাটতে আসা ব্যক্তিরা অনুমতিপত্র দেখাতে না পেরে পালিয়ে যান। এই ঘটনায় চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। এক প্রবীণ বাসিন্দা শ্রী অমল মুখার্জি বলেন, “এত বড় গাছ দিনের আলো না ফোটার আগেই কাটা হয়েছে! এটা কোনদিন ভাবিনি। আমরা এত গাছ লাগাই, সরকারও উৎসাহ দেয়, আর কেউ যদি সরকারি জমির গাছ কেটে দেয়, সেটা কীভাবে মেনে নিই?” জানা গেছে, ছাতিম গাছ দুটি দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় ছায়া দিত, পথচারীরা গরমে কিছুটা বিশ্রাম নিতেন ওই গাছের তলায়। আর এতবছরের পুরনো ছায়া-দেয়া সেই গাছ হঠাৎ করে এভাবে নিধন, তা মানতে পারছেন না কেউই। বনদপ্তরের এক কর্মী ঘটনাস্থলে পৌঁছে গাছটি বাজেয়াপ্ত করেন এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে দপ্তরে জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে চরম ক্ষোভ জানিয়েছেন পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের বনভূমি কর্মাধ্যক্ষ শ্রী নিত্যানন্দ ব্যানার্জি। তিনি “খবর বাংলা”-কে জানান, “আমরা ইতিমধ্যেই ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পেরেছি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সরকারি জমির গাছ কাটা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। এই ঘটনায় শুধু গাছ নয়, পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ে, আমরা চাই না এমন ঘটনা আর ঘটুক।” প্রশ্ন উঠছে, কিভাবে কেউ সরকারি জায়গায় থাকা এতবড় গাছ কেটে ফেলতে পারে কোনওরকম অনুমতি ছাড়াই? এলাকাবাসীরা আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনা হয়তো প্রথম নয়, আরও অনেক জায়গায় এরকম গোপনে গাছ কাটা হচ্ছে, যার কোনও খোঁজ প্রশাসনের কাছে নেই। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য শ্রীমতি সীমা ঘোষ জানান, “আমরা চাই বনদপ্তর থেকে তদন্ত হোক এবং এরকম বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এই গাছগুলো শুধু গাছ নয়, আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য, আমাদের আশ্রয়।” বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি পরিণত ছাতিম গাছ দিনে প্রায় ১০০ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, শহর বা গ্রামের বায়ু শুদ্ধ রাখে, আর সেই গাছ কেটে ফেলার মানে হল পরিবেশের ওপর সরাসরি আঘাত। বনদপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, যেহেতু এটি সরকারি জমি, তাই গাছ কাটতে হলে অবশ্যই পরিবেশ দপ্তর বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি প্রয়োজন, এবং সেটা না থাকলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

এই ঘটনার জেরে এবার এলাকার মানুষ চাইছেন সরকারি জমির গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নজরদারির ব্যবস্থা হোক। অনেকে দাবি তুলেছেন, সরকারি গাছের পাশেই সাইনবোর্ড দিয়ে লেখা থাকুক – “এই গাছ সরকারি সম্পত্তি, কাটা আইনত দণ্ডনীয়”। একইসাথে, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বলছেন, “আমরা যেখানে ‘গাছ লাগান, জীবন বাঁচান’ শিখছি, সেখানে এমন ঘটনা আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই বিপজ্জনক।” এই ঘটনাটি নতুন করে গাছ রক্ষা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ডাক দিচ্ছে সমাজে। প্রশাসনের কাছে এলাকাবাসীর আবেদন, শুধু তদন্ত নয়, এমন কঠোর শাস্তি হোক যাতে কেউ আর সাহস না পায় গাছ কাটতে। পরিবেশপ্রেমীদের মতে, এখন সময় গাছকে শুধু কাঠ হিসেবে না দেখে জীবনের অংশ হিসেবে ভাবার। আর সরকার যেখানে নিজেই প্রচার করছে – “সবুজ বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও”, সেখানে সরকারিভাবে দায়িত্ব থাকা গাছ যদি এভাবে কাটা যায়, তাহলে সেই প্রচার কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে। এখন দেখার, প্রশাসন এই ঘটনার বিরুদ্ধে কতটা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের বেআইনি গাছ কাটা বন্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।