Potters’ clay pitchers are popular for quenching thirst. : গ্রীষ্ম মানেই গা জ্বালানো রোদ, ফেটে যাওয়া মাটি আর অসহনীয় তৃষ্ণা। আর এই তৃষ্ণা নিবারণে গ্রামবাংলার বহু পুরনো সঙ্গী হলো কুম্ভকারদের হাতে তৈরি মাটির কলস। এই কলস শুধু একটা জল রাখার পাত্র নয়, এটা একটা ইতিহাস, একটা সংস্কৃতি, একটা আবেগ, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো মানুষের জীবনের গল্প। মাটির কলসের ঠান্ডা জল যে শান্তি দেয়, তা কোনো ফ্রিজ বা বোতলজাত জলে নেই। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে আজও বহু মানুষ এই মাটির কলস ব্যবহার করেন এবং সাম্প্রতিক কালে হঠাৎ করেই এই কলসের চাহিদা যেন আরও বেড়েছে। পূর্ব বর্ধমান, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি কিংবা বাঁকুড়া – সর্বত্রই এখন গরমে শীতল জলের খোঁজে মানুষ ফিরছেন এই প্রাকৃতিক ‘কুলার’-এর দিকে। বাঁকুড়ার সোনামুখী, নদিয়ার শান্তিপুর কিংবা হুগলির ঘোড়াঘাটা – এই এলাকাগুলি বহু পুরনো কুম্ভকার শিল্পের কেন্দ্র। এখানকার কারিগররা এখন দিনরাত এক করে তৈরি করছেন নানা রকম কলস – ছোট, বড়, কলার গলা, হাতল-সহ বা হাতল ছাড়া। “আগে তো আমরা দিনে ৫-৬ টা কলস বিক্রি করতাম। এখন দিনে ২০ টার বেশি বিক্রি হচ্ছে,” বলছিলেন বাঁকুড়ার কুম্ভকার অমল ঘোষ। তিনি আরও বলেন, “শুধু গ্রামের লোক নয়, শহর থেকেও এখন লোক আসছে কিনতে। অনেকেই বলেন ফ্রিজের জল গলা বসিয়ে দেয়, কিন্তু কলসির জল শরীরের পক্ষে অনেক ভালো।” আসলেই, ডাক্তারদের মতে, মাটির কলসের জল প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা হয় এবং তাতে শরীরের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরিন বা ফ্লুরাইডজাত রাসায়নিক থাকে না। তাছাড়া এই জল হজমের সহায়ক, এবং এটি কিডনি ও যকৃতের ওপরও ভালো প্রভাব ফেলে। তাই শহরের স্বাস্থ্য সচেতন মানুষজনও এখন দলে দলে কিনে নিচ্ছেন মাটির কলস।
কলকাতার বেহালার বাসিন্দা মেঘলা সেন বললেন, “আমার ছেলে রোজ বমি করত ঠান্ডা জল খেয়ে, এখন মাটির কলসের জল খাওয়ানোর পর থেকে ওর শরীর ভালো আছে।” শুধু তাই নয়, পরিবেশ বান্ধব জীবন যাপনে উৎসাহী নতুন প্রজন্মও মাটির কলসের দিকে ঝুঁকছে। মাটির কলস পুনর্ব্যবহারযোগ্য, একেবারে প্রাকৃতিক এবং সহজপাচ্য – তাই পরিবেশ সংরক্ষণের দিক থেকেও এটি শ্রেষ্ঠ বিকল্প। এখনকার ডিজাইনার কলসের বাহারও কম নয়। আধুনিক নকশা, রঙিন মাটি, সুন্দর অলংকরণ – এসব দিয়েই এখন কলসকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন বাজার। দক্ষিণ কলকাতার এক নামী হস্তশিল্প বিপণীর কর্ণধার ঋতুপর্ণা বসু জানালেন, “আমরা এখন বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা মাটির কলসি আনাচ্ছি রাজস্থানের কারিগরদের কাছ থেকেও। আধুনিক ফ্ল্যাটে রাখার মতো সুন্দর এবং কাজের উপযোগী করে বানানো হচ্ছে। শহরের ক্রেতারাও দারুণ উৎসাহী।” মাটির কলসের ঐতিহ্য কিন্তু আজকের নয়। এই কলস হাজার হাজার বছরের পুরনো। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, বৈদিক যুগ – সর্বত্রই ছিল এই কলসির প্রচলন। সেই ঐতিহাসিক ধারারই অংশ আমাদের বাংলার কুম্ভকার শিল্প। চন্দ্রকেতুগড়, পাণ্ডুয়া, দেবীপাহাড়, বগুড়ার মহাস্থানগড় – সর্বত্র মিলেছে বহু প্রাচীন মৃৎপাত্র, যার মধ্যে ছিল কলস। এই কলসের কথা উঠে এসেছে সাহিত্যে, গানে, পুরাণে, লোককথায়।
“আমার কাংখের কলসি জলে গিয়েছে ভাসি” – এই গান শুধু একটা প্রেমের দুঃখ নয়, এটা এক গভীর সাংস্কৃতিক প্রতীক, যেখানে কলসি হয়ে উঠেছে স্মৃতি, আশা, অপেক্ষা, বিরহ আর ভালবাসার বাহক। নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের যুগেও কলসির উল্লেখ আছে। কলসিতে মদ রেখে মাধাই ছুড়ে মারেন নিত্যানন্দ প্রভুকে – সেই কলস তখন শুধুমাত্র এক বস্তু নয়, সেই কলস এক হিংসার প্রতীক, আবার পরে তা হয়ে ওঠে ক্ষমা ও প্রেমের সাক্ষী। আবার অন্যদিকে বেহুলার কলসি – সেখানে কলসি মানেই লজ্জা, মর্যাদা, আবেগ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০১১ সালে ইসরায়েলের এক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ১৩ শতকের কলস আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মৃতদেহ সংরক্ষণ, ওষুধ তৈরি, শস্য সংরক্ষণ – এমনকি দেবতার পূজা পর্যন্ত কলসির মাধ্যমে হয়েছে। আজকের দিনে সেই ঐতিহ্য যেন আবার ফিরে আসছে বাংলার গাঁয়ে গঞ্জে। অবশ্য কলসির এই বাড়তি চাহিদা যেমন কুম্ভকারদের মুখে হাসি ফিরিয়েছে, তেমনি কিছু সমস্যা ও আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, বৃষ্টি না হলে ভালো মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, আবার কাঠের ঘাটতি ও জ্বালানি মূল্যের কারণে কলস পোড়ানোর খরচ বেড়েছে। বাঁকুড়ার কারিগর বিপ্লব পাল বলেন, “মাটি ভালো না হলে কলস ভেঙে যায়, আবার সরকার থেকে কোনো সাহায্যও পাই না।
এখন যদি একটু প্রশিক্ষণ আর উন্নত সরঞ্জাম পেতাম, তাহলে আরও ভালো কাজ করতে পারতাম।” এই দিকটি প্রশাসনের নজরে আনা খুব জরুরি। সরকারি প্রকল্পের আওতায় কুম্ভকার শিল্পকে তুলে ধরার উদ্যোগ থাকলেও সঠিক বাস্তবায়নের অভাব বহু এলাকায় চোখে পড়ে। যদিও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং স্থানীয় কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখন এই শিল্প রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে। তারা গ্রামের কুম্ভকারদের ডিজাইন শিখিয়ে দিচ্ছে, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রির উপায় জানাচ্ছে। এই মিলিত উদ্যোগ যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী দিনে বাংলার মাটির কলসি শুধু তৃষ্ণা মেটাবে না, রুজির রুটিও দেবে বহু পরিবারের। তৃষ্ণার গরমে যখন শরীর ঝলসে যায়, তখন একটা শীতল মাটির কলসি যেন প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। আর সেই কলসের জলে যখন মায়ের হাতে ভরা এক গ্লাস জল তুলে দেওয়া হয়, তখন সে শুধু জল নয়, যেন ভালোবাসা, ইতিহাস আর সংস্কৃতির এক গ্লাস ভরাট হয়ে ওঠে। তাই ফিরে আসুক কলসি, ফিরে আসুক কুম্ভকারদের সম্মান, ফিরে আসুক আমাদের শিকড়ে ফেরার পথ।