Wednesday, April 16, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যআত্রাই নদীর সংকট মেটাতে পরিদর্শনে নদী বিশেষজ্ঞরা

আত্রাই নদীর সংকট মেটাতে পরিদর্শনে নদী বিশেষজ্ঞরা

River experts visit to resolve Atrai River crisis: “আত্রাই নদী, আমাদের বেঁচে থাকার একটা অংশ, আজ তারই বুক শুকিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে”—এই কথাগুলো বলছিলেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের এক বৃদ্ধ মৎস্যজীবী গোপাল বাউড়ি, যিনি ছোটবেলা থেকে আত্রাই নদীর জলে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ সেই নদী যেন এক মৃতপ্রায় রূপ নিয়েছে। জল নেই, স্রোত নেই, আর মাছ তো বহুদিনই হারিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতির মুখে এবার ‘এসো নদীর সাথে চলি’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বালুরঘাটে এলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নদী গবেষক ও পরিবেশপ্রেমীদের একটি দল। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাহবুব শাহানার নেতৃত্বে এই বিশেষজ্ঞ দলটি আত্রাই নদীর সংকটের মূল কারণ অনুসন্ধানে এক জরুরি পরিদর্শনে এসেছেন।আত্রাই নদী—বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলির একটি। এই নদী রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাটসহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত কুশিয়ারা ও বার্নি নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে আত্রাই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট অংশ দিয়ে। কিন্তু গত কয়েক দশকে নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশের রবার ড্যাম এবং বালুরঘাট অংশে নির্মিত চেক ড্যাম এই সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।অধ্যাপক মাহবুব শাহানা জানান, “নদীর জল কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তা বোঝার পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত ভারসাম্যের উপর কতটা প্রভাব পড়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। নদী একটি জীবন্ত প্রাকৃতিক সত্তা। তার স্বাভাবিকতা নষ্ট হলে সেই অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি, কৃষি এবং জীববৈচিত্র্য সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”এই গবেষণায় অংশ নেওয়া অন্য এক নদী গবেষক সুস্মিতা দে বলেন, “আমরা নদীর গতিপথ, গভীরতা, নদীর পাড়ের অবস্থা এবং জল প্রবাহের মডেলিং-এর মাধ্যমে একটা স্পষ্ট চিত্র তৈরি করার চেষ্টা করছি। স্থানীয়ভাবে যেসব ড্যাম তৈরি হয়েছে সেগুলোর প্রকৃত প্রভাব ও জলসংকটের যোগসূত্রও আমরা খুঁজে দেখছি।”

বালুরঘাটে পরিদর্শনের সময় গবেষক দলটি নদীর পাশে বসবাসকারী গ্রামবাসীদের সঙ্গে দীর্ঘসময় ধরে কথা বলেন। স্থানীয় কৃষক রবীন্দ্র দাস জানান, “আগে আমাদের জমিতে সারা বছর ফসল হত। আত্রাই নদীর জল দিয়েই সব হত। এখন বৃষ্টির জল ছাড়া চাষ হয় না, আর নদীর জল পাম্প দিয়েও তুলতে পারি না। নদীর পাড় ভেঙে যাচ্ছে, জোয়ার-ভাটাও নেই, জল জমে থেকে রোগবালাই বাড়ছে।”একই সুর শোনা গেল রিনা খাতুনের গলায়, যিনি বললেন, “আগে আমরা নদীতে স্নান করতাম, কাপড় কাচতাম, বাচ্চারা খেলা করত। এখন নদীটা যেন একটা জলহীন খাদে পরিণত হয়েছে। পশু-পাখিরাও যেন কাঁদছে, জল না পেয়ে।”পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ‘নদীযাত্রা’র সদস্য দীপঙ্কর পাল জানান, “আত্রাই নদীর এই সংকট মূলত জলধারণ ক্ষমতা হারানো, ড্রেজিং-এর অভাব, পাড় দখল, চেক ড্যাম ও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফল। আমাদের দেশে নদীকে শুধু জল দেওয়ার উৎস ভাবা হয়, কিন্তু তার জীববৈচিত্র্য এবং সামাজিক ভূমিকা প্রায় ভুলে যাওয়া হয়েছে।”এই পরিদর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল নদী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের বৈঠক। সেখানে নদী সংরক্ষণ ও পুনর্জীবনের রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতে এই ধরণের গবেষণাকে সহযোগিতা করা হবে এবং নদী রক্ষায় আরও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

images?q=tbn:ANd9GcTUZxoxSiMQtmscPRLY4Wza5 QRyAqruZGRwA&s

গবেষক দলের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে যে তথ্য উঠে এসেছে তা হলো, বাংলাদেশের রবার ড্যাম নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ রোধ করছে। ফলে নদীর জলধারার ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেইসঙ্গে বালুরঘাট অংশে চেক ড্যাম গুলি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় জল আটকে যাচ্ছে, যার ফলে নদীর গভীরতা কমে গিয়েছে এবং নদীতে সঞ্চিত বালির স্তর বেড়েছে।স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন, এই ধরনের গবেষণা এবং পরিদর্শন শুধু নদী নয়, তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকেও রক্ষা করবে। নদীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শুধু জল সংগ্রহের নয়, তা হল আবেগ, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্বের মিলনস্থল।একজন প্রবীণ শিক্ষক, গৌরাঙ্গ ঘোষ বলেন, “নদী বাঁচলে গ্রাম বাঁচবে, সমাজ বাঁচবে। তাই এই গবেষণা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি আমাদের জন্য আশার আলো। তবে শুধু গবেষণা নয়, সরকার ও প্রশাসনের বাস্তব পদক্ষেপ জরুরি। নদী যেন না শুকোয়, এই আশা আমাদের।”‘এসো নদীর সাথে চলি’ কর্মসূচি আগামী দিনে আরও নদী অঞ্চল পরিদর্শন করবে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কাজ করে নদী বাঁচানোর রূপরেখা তৈরি করবে। গবেষক দলটি আগামী সপ্তাহে নদীর উৎসস্থল এবং নিম্নপ্রবাহ অঞ্চলেও যাবেন বলে জানা গেছে।এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে শুধু আত্রাই নয়, উত্তরবঙ্গের বহু নদী ও তাদের আশপাশের জনজীবনও ভয়ানক সংকটের মুখে পড়বে। সময় থাকতে নদীর ড্রেজিং, বাঁধ সংস্কার, জনসচেতনতা এবং প্রশাসনিক তৎপরতা একযোগে না হলে এই সংকট ভবিষ্যতে মহাসঙ্কটে রূপ নিতে পারে।পরিশেষে বলাই যায়, নদী কেবল একটি জলধারা নয়, সে হলো সভ্যতার ধারক-বাহক। আত্রাই নদীর সংকট শুধু জল সংকট নয়, তা হলো মানুষের অস্তিত্বের সংকট। এই সংকট মোকাবেলায় আজকের এই নদীযাত্রা, গবেষণা ও স্থানীয় মানুষদের মনের কথা শোনার এই প্রয়াস হয়তো নদী বাঁচানোর পথের শুরু।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments