Tuesday, April 15, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যযে কোনও বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা! হতে পারে মারাত্মক ক্ষতি

যে কোনও বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা! হতে পারে মারাত্মক ক্ষতি

Overthinking:”যে কোনও বিষয় নিয়ে ভাবনা কখনও কখনও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ওভার থিঙ্কিংয়ের ফলে সবথেকে বেশি সমস্যা হয় নিজেরই।” — ঠিক এই কথাটিই আজকাল যেন মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। হালফিলে ‘ওভারথিঙ্কিং’ বা অতিরিক্ত চিন্তা যেন এক নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে, বিশেষ করে এই জেনারেশনের মধ্যে। বহু মানুষ আজ এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে তারা একটানা কোনো একটা বিষয় নিয়ে এত বেশি ভাবছেন যে, সেটা শুধু মনের উপর নয়, শরীরের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। উত্তর কলকাতার বেলঘরিয়ার বাসিন্দা সোনালী মুখার্জী, যিনি একজন স্কুলশিক্ষিকা, জানিয়েছেন, “একটু সমস্যা হলেই মনে হয় যেন সব শেষ। এমনটা ভাবতে ভাবতেই রাতে ঘুম আসে না, খাওয়াও ঠিক মতো হয় না।” সোনালীর মতো বহু মানুষ আছেন যাঁরা দিনের পর দিন এভাবে নিজেকে মানসিকভাবে শেষ করে ফেলছেন, অথচ বিষয়টা যে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তা হয়তো বুঝতেই পারছেন না।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডঃ অরুণাভ সরকার বলেন, “ওভারথিঙ্কিং হল এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ একটা বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ভাবতে ভাবতে বাস্তবতা থেকে অনেকটা সরে যায়। সেটা হতে পারে সম্পর্ক, কাজ, ভবিষ্যৎ, বা অতীতের কোনও ঘটনা। কিন্তু এই চিন্তাভাবনার ফল শুধু মানসিক দুর্বলতা নয়, দীর্ঘমেয়াদে দেখা দিতে পারে অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ, হজমের সমস্যা, এমনকি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের সম্ভাবনাও।” তাঁর মতে, “এটা একটা প্রোগ্রামড হ্যাবিট, মানে ছোট থেকে আমরা চিন্তা করতে শিখি, কিন্তু কখন সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সেটা অনেকেই বুঝতে পারি না।”

1678723674885?e=2147483647&v=beta&t=5zoUSWdMwMCi j5y8omDF1ho39Og4V9bcyooUETfKHo

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওভারথিঙ্কিং-এর পিছনে আছে নানা কারণ — যেমন ব্যক্তি জীবনে চাপ, চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের সমস্যা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ইত্যাদি। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এই অতিরিক্ত চিন্তার অভ্যাস মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আজকের দিনে একজন মহিলাকে ঘরের কাজ, বাইরের দায়িত্ব, সন্তানের দেখাশোনা, পরিবার সামলানো—সবই করতে হয় একসাথে। আর এই চাপটাই ধীরে ধীরে গড়ে তোলে এক অদৃশ্য মানসিক বোঝা। মধ্যবয়সী গৃহবধূ ঊষা দত্ত বলেন, “বাচ্চার স্কুল, স্বামীর অফিস, শাশুড়ির ওষুধ—সবই আমাকে মনে রাখতে হয়। একটু কিছু হলেই মনে হয় আমি ব্যর্থ। সারা রাত ঘুম ভাঙে, মনে হয় কী হবে কালকে!” এমনটা শোনাও খুব সাধারণ হয়ে গেছে আজকাল।

মেয়েদের মনের ওপর চেপে থাকা এই দুশ্চিন্তার বোঝা ধীরে ধীরে জন্ম দেয় উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, প্যানিক অ্যাটাকের মতো সমস্যার। সাইকোথেরাপিস্ট রুবিনা ঘোষ বলেন, “এটা মোটেও তুচ্ছ কোনও সমস্যা নয়। যারা এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যান, তারা জানেন কতটা অসহায় লাগে। অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারেন না সমস্যাটা কোথায়।” তিনি বলেন, “এই সময়ে যেটা খুব দরকার সেটা হল একটা পজিটিভ লাইফস্টাইল তৈরি করা। সবসময় খারাপ দিক না ভেবে, ভালো দিক দেখার অভ্যাস করতে হবে।”

ওভারথিঙ্কিং-এর প্রভাব শুধু মানসিক নয়, শারীরিক দিকেও ব্যাপক ক্ষতিকারক। বহু গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত চিন্তা করার ফলে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়, যা শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর প্রভাব ফেলে। উচ্চ রক্তচাপ, হজমের সমস্যা, ঘুমের অভাব, এমনকি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। WHO-র রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ মানসিক চাপজনিত সমস্যায় ভুগছেন, যার মধ্যে বিশাল একটা অংশ এই ‘ওভারথিঙ্কিং’ সমস্যায় আক্রান্ত। ২০২৩ সালে ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থা NIMHANS-এর এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, ভারতের শহরাঞ্চলে প্রায় ৬৫% যুবক-যুবতী এই সমস্যায় আক্রান্ত, যদিও অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না।

shutterstock 2092245412

এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? ডঃ অরুণাভ সরকারের মতে, “প্রথমত, নিজেকে বুঝতে হবে, আপনি চিন্তা করছেন নাকি আপনি ‘ওভারথিঙ্ক’ করছেন। তারপরে ধাপে ধাপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মেডিটেশন, ইয়োগা, ডিপ ব্রিদিং, রুটিন তৈরি করা, নিজের জন্য সময় রাখা, ফোন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে একটু বিরতি নেওয়া—এসবই হতে পারে ভালো উপায়। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নিতে হবে, সেটা মোটেও লজ্জার নয়।”

তবে এই সমস্যার একটা বড় দিক হলো সামাজিক চাপ। আমরা সবাই চাই সফল হতে, আমরা চাই সবাই আমাদের ভালো বলুক। সেই চাহিদা থেকেই শুরু হয় অল্পতেই অতিরিক্ত ভাবনা। কেউ একটা খারাপ কথা বললেই আমরা সেটা নিয়ে সারাদিন মাথা ঘামাই, কেউ ফোন ধরল না মানে হয়তো কিছু খারাপ ভাবছে—এইসব ভ্রান্ত ধারণা থেকেই জন্ম নেয় এক অদ্ভুত মানসিক অস্থিরতা। সমাজ মনোবিদ শ্রীমতী অনন্যা সেন বলেন, “এটা একপ্রকার সাইকোলজিক্যাল ট্র্যাপ। নিজেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।”

এইসব মানুষের জন্য খুশির খবর হলো, ‘ওভারথিঙ্কিং’ কাটিয়ে উঠতে গেলে প্রথমেই দরকার সচেতনতা। সবাইকে বুঝতে হবে যে এটা রোগ নয়, অভ্যাস। আর অভ্যাস যেমন গড়ে ওঠে, তেমনই বদলানোও যায়। নিয়মিত শরীরচর্চা, নিজের জন্য সময় বের করা, খোলামেলা কথা বলা, কাউন্সেলিং নেওয়া—এসবই হতে পারে সুস্থ জীবনের প্রথম পদক্ষেপ।

‘খবর বাংলা’ পরিবারের তরফ থেকে আমরা আমাদের সকল পাঠককে এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন করতে চাই। নিজের এবং কাছের মানুষের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন। একটু সময় দিন, শুনুন, পাশে থাকুন। কারণ এই ‘ভাবনার অতিরিক্ত বোঝা’ কখন যে মারাত্মক আকার নেয়, তা কেউ বলতে পারে না।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments