Ayodhya: অযোধ্যা এখন যেন একেবারে রামভক্তির ঢেউয়ে ভাসছে। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো ভগবান রামলালাকে রাম জন্মভূমির নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, আর সেই থেকেই যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এবার দ্বিতীয়বারের মতো রামনবমী উদযাপন হচ্ছে এই নতুন রাম মন্দিরে, আর গোটা অযোধ্যা যেন পরিণত হয়েছে এক বিশাল তীর্থক্ষেত্রে। প্রভু রামের জন্মোৎসব ঘিরে শহরের প্রতিটি কোণায় কোণায় ভক্তি, আধ্যাত্মিকতা আর আনন্দের পরিবেশ। মন্দির চত্বরে ঢুকতেই চোখে পড়ে, রঙবেরঙের ফুলে, তোরণে আর আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে প্রতিটি ইঞ্চি। সন্ধ্যার পরে যখন মন্দির আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে, তখন যেন এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়, চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী, এই বছর প্রায় ৫০ লাখ ভক্ত অযোধ্যায় সমবেত হয়েছেন রামনবমীর উৎসবে যোগ দিতে। শুধুই দেশের নানা প্রান্ত নয়, বিদেশ থেকেও বহু ভক্ত আসছেন রামলালার দর্শনে। সরযূ নদীর ধারে ভক্তদের ঢল, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, ঘাটে ঘাটে প্রার্থনা—সব মিলিয়ে একেবারে পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় উৎসবের চেহারা নিয়েছে গোটা শহর।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে কুম্ভমেলা শেষ হওয়ার পরে ফের আগের সময়সূচি চালু হয়েছে রামলালার দর্শনের জন্য, আর ভক্তদের ভিড় তাতে আরও বেড়েছে। মন্দিরে প্রবেশের মুখে প্রধান দ্বারটিকে সাজানো হয়েছে ফুল, আলো আর ধর্মীয় উপকরণে—একটি বিশাল স্বাগত ফটক তৈরি করে যেন বলা হচ্ছে, ‘এসো রামভক্ত, এই তীর্থ তোমার জন্য’। শুধু মন্দির নয়, গোটা শহরের রাস্তা ঘাট, অলিগলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে, আবর্জনার চিহ্নমাত্র নেই। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে তোরণ তৈরি হয়েছে, অনেক জায়গায় ধর্মীয় গান বাজছে—ভজন, কীর্তন, ঢোল-নগাড়ার শব্দে আকাশ-বাতাস মুখরিত। মন্দিরের গর্ভগৃহ, যেখানে রামলালার মূর্তি বিরাজমান, সেটিকেও বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। সিংহাসন, ব্যাকড্রপ, সিলিং—সবকিছুতেই চোখে পড়ার মতো শিল্পশৈলী আর ভক্তির ছোঁয়া।
সরযূ নদীর তীরে, যেখানে রামের জন্মস্থানের অন্যতম চিহ্ন ‘রাম কি পৈদাই’ ঘাট রয়েছে, সেখানেও হাজার হাজার ভক্ত প্রার্থনা করছেন। মোমবাতি, ধূপ, ফুল নিয়ে রামনবমীর শুভক্ষণে রামকে স্মরণ করছেন ভক্তরা। অনেকেই নিজেদের মনস্কামনার কথা জানিয়ে, নদীতে অঞ্জলি দিচ্ছেন। এই সমারোহে সবচেয়ে খুশি হয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মন্দির সংলগ্ন দোকান, হোটেল, খাবার হাউস, এমনকি ঠেলাগাড়ির বিক্রেতারাও বলছেন—এই ভিড় তাদের জীবনে একরকম আশীর্বাদ। একজন স্থানীয় চায়ের দোকানদার বলেন, “রামলালার কৃপায় ব্যবসা এমন চলছে, আগে কল্পনাও করতে পারিনি। সকাল থেকে রাত, একটানা লোক আসছে।”
এই মন্দির শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিক দিয়েও এক বিরাট মাইলফলক। রাম মন্দির নির্মিত হয়েছে নগর স্থাপত্যশৈলীতে, যার দৈর্ঘ্য ৩৮০ ফুট, প্রস্থ ২৫০ ফুট আর উচ্চতা ১৬১ ফুট। মন্দিরে রয়েছে তিন তলা, প্রতিটিতে খোদাই করা ৩৯২টি স্তম্ভ, এবং ৪৪টি দরজা। গর্ভগৃহে রামলালার শৈশব মূর্তি প্রতিষ্ঠিত, আর প্রথম তলায় রয়েছে শ্রী রাম দরবার। পুরো মন্দির চত্বরটি তৈরি হয়েছে একদম প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য রীতি মেনে। মন্দির নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে গোলাপি বালু পাথর, যা রাজস্থানের ভরতপুর থেকে আনা হয়েছে। কোনো লোহার ব্যবহার ছাড়াই তৈরি হয়েছে এই মহান কীর্তি। এই মন্দিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এটি দেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশ সরকার অযোধ্যাকে ‘ধর্মীয় পর্যটনের রাজধানী’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়ন শুরু করেছে।
ভবিষ্যতের দিক থেকে দেখতে গেলে, অযোধ্যায় এত বড় মাপের উৎসব, এত মানুষের সমাগম, শহরের পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রশাসনকে আরও পরিকল্পিতভাবে জল, নিকাশি, ট্রাফিক, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এই বছর রামনবমীতে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে—প্রতি কোণে নজরদারি ক্যামেরা, ড্রোনের সাহায্যে ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে।
এই উৎসবের গভীরে রয়েছে এক নিরন্তর ভক্তি আর বিশ্বাস, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে এক করে এসেছে। রাম জন্মভূমি নিয়ে বহু দশকের বিতর্কের পরে এখন সেই ভূমি এক শান্তি, ঐক্য আর আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অযোধ্যার প্রতিটি মানুষ এখন গর্বিত যে তারা এমন এক শহরের বাসিন্দা, যেখানে রামলালার বসবাস। এই অনুভূতিই তাদের নতুন করে উৎসাহ দেয় শহরকে পরিষ্কার রাখতে, অতিথিদের সম্মান জানাতে এবং বিশ্বকে দেখাতে—হ্যাঁ, এটাই আমাদের রামনগরী, এটাই আমাদের গর্ব।