Even in the digital age, the Bengali people’s records are intact. : যুগ বদলেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষের অভ্যাস, চিন্তাভাবনা, জীবনযাত্রা, এমনকি ব্যবসা করার পদ্ধতিও। কাগজের খাতা আর কলমের জায়গা নিয়েছে মোবাইল, ল্যাপটপ আর সফটওয়্যার, হিসেব এখন আর কপালে টিপ দিয়ে খাতায় লিখে রাখা হয় না, এখন সব ডেটা যায় এক ক্লিকে কম্পিউটারে কিংবা ক্লাউডে। তবু এর মাঝেই কোথাও যেন রয়ে গিয়েছে এক টুকরো বাঙালিয়ানা, একটুকরো নস্টালজিয়া, একটুকরো অনুভূতির নাম— হালখাতা। নতুন বাংলা বছরের প্রথম দিনে, ১লা বৈশাখে দোকানপাটে পুরনো হিসেব গুটিয়ে নতুন খাতা খোলার যে প্রথা, তা এখনও বহু ব্যবসায়ীর মনে ধরে আছে বড় যত্নে। এ যেন শুধুই হিসেব-নিকেশের ব্যাপার নয়, বরং এক
আবেগের বিষয়, এক শুভ সূচনার রীতি, এক নিরবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা এখনও ডিজিটাল ঝড়েও টিকে রয়েছে অনেক দোকানে, অনেক বাজারে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক, হলদিয়া, কাঁথি, এগরা কিংবা খড়গপুর—এইসব জায়গার পুরনো বাজারে ঘুরলে দেখা যায় কিছু দোকানে এখনো ক্যালেন্ডারের গায়ে লাল রঙের ছাপ, হালখাতার গায়ে শাঁখা-সিঁদুর আর ধূপকাঠির গন্ধ মেশানো স্মৃতি। ছোট ছোট ছাপাখানাগুলোতে এখনও চলছে শেষ মুহূর্তের প্রিন্টিং—নতুন ক্যালেন্ডার, পঞ্জিকা, আর লাল বাইন্ডিং করা খাতা। যদিও আগের সেই ধুমধাম আর নেই, বিক্রিও হয়েছে একদম কম। ছাপাখানার এক পুরোনো কর্মী নিমাই হালদার জানালেন, “আগে বৈশাখ এলেই রাতদিন ছাপার কাজ চলত, এখন তো কেউ ক্যালেন্ডার ছাপাতে চায় না। পাঁচটা দোকানদার মিলে একটা করে হালখাতা নেয়, ক্যালেন্ডার ছাপায় ২০ কপি। আগে ২০০-৩০০ কপি হতো।” একটা সময়ে দোকানে দোকানে খাতা খোলার দিন মানেই ছিল খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ, ধূপধুনো, সাদা কাপড় পরা বাবাজি আসতেন মন্ত্র পড়তে,
আর গ্রাহকেরা আসতেন পুরনো বকেয়া মিটিয়ে নতুন বছরে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে। এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই বিরল। অথচ এখনো কেউ কেউ নিয়ম রক্ষা করেন। যেমন হলদিয়ার কাপড় ব্যবসায়ী অনুপ চৌধুরী বলেন, “আমি ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছি, এখনও বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন খাতা খুলি, যদিও হিসেব রাখি সফটওয়্যারে। হালখাতা খোলাটা একটা শুভ দিন, একটা রীতি, তাই তা চালিয়ে যাচ্ছি।” আবার তমলুকের এক স্টেশনারি দোকানদার বিজন মুখার্জি বলেন, “বেশিরভাগ ক্রেতা এখন ক্যালেন্ডার আর নেয় না, তারা বলে ‘আমার ফোনেই সব থাকে।’ কিন্তু একটা ক্যালেন্ডার টাঙানো, তাতে নববর্ষের শুভেচ্ছা লেখা, এটা একটা মানসিক আনন্দ, যেটা ফোনে হয় না।” এখন প্রশ্ন আসে, তাহলে কি হালখাতা একেবারেই হারিয়ে যাবে? নাকি বদলে যাবে তার রূপ? আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু যেমন হারায়, তেমনি কিছু কিছু বদলে গিয়েও রয়ে যায়। হালখাতা হয়তো আর আগের মত মহাসমারোহে হয় না, হয় না খাওয়াদাওয়া আর বড়সড় নিমন্ত্রণ, কিন্তু তার ছায়া এখনও রয়েছে অনেক দোকানে। অনেকে কেবল মাত্র শুভ সূচনার জন্য একটি ছোট খাতা রাখেন, যাতে প্রথম পাতায় লেখা থাকে ‘শুভ হালখাতা’ আর একটা লাল টিপ দিয়ে দেন। ডিজিটাল ক্যালকুলেশন, GST বিল, অনলাইন পেমেন্ট, সবকিছুই থাকলেও, এই একটি ছোট্ট প্রথার মধ্যে লুকিয়ে থাকে বাঙালির একটা বিশুদ্ধ আনন্দ। কলকাতার বড়বাজারে হালখাতার দোকান গুলির চাহিদাও একসময় ছিল তুঙ্গে। এখন অনেক দোকানই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কেউ কেউ ভিন্ন ব্যবসায় চলে গিয়েছেন। রাজা কাঠার এক প্রবীণ হালখাতা বিক্রেতা বললেন, “একসময় পুজোর আগে, নববর্ষের আগে আমাদের ঘুম হত না, এখন তো গোটা দিনে ২টা খাতা বিক্রি হয় না। তবু আমরা ছাপাই, কারণ কিছু

দোকান এখনও আমাদের অর্ডার দেয়।” এই প্রথা শুধু ব্যবসার নয়, বরং তা গ্রাহক-ব্যবসায়ী সম্পর্কের এক পুনর্নবীকরণ। ক্রেতা দোকানদারকে শুভ নববর্ষ বলেন, দোকানদার তাঁকে মিষ্টিমুখ করান, একে অপরকে স্মরণ করিয়ে দেন পুরনো সম্পর্ক, যা শুধুমাত্র হিসেবের নয়, মন ও স্মৃতির। এই হালখাতা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাংলা পঞ্জিকা, ক্যালেন্ডারও। এখন অবশ্য বেশিরভাগ মানুষ ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেন মোবাইলেই। কিন্তু এখনও গ্রামের দিকে বা ছোট শহরগুলিতে ঘরে ঘরে দেখা যায় বাংলা ক্যালেন্ডার ঝোলানো থাকে, যেখানে লেখা থাকে ‘আজ একাদশী’, ‘আজ অমাবস্যা’, কিংবা ‘আজ মহালয়া’। এই ক্যালেন্ডার মানুষকে স্মরণ করায় তাঁদের শিকড়ের কথা, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের সংস্কৃতি। তাই বলাই যায়, হালখাতা হারিয়ে যাচ্ছে না, বরং সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে তার রূপ, মানে ও মর্যাদা। যেসব দোকানদার এই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন, তাঁরা যেন সময়ের ভেতর দিয়ে এক সেতু তৈরি করছেন অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে। বাঙালির কাছে নববর্ষ মানে শুধু পান্তা-ইলিশ নয়, মানে হালখাতার প্রথম পাতায় ‘শুভ নববর্ষ ১৪৩২’ লেখার সেই মুহূর্তটা, যেখানে গন্ধ মেশানো থাকে ইতিহাস, আবেগ আর সংস্কৃতির। আগামী দিনে হয়তো কাগজের হালখাতা আরও কমবে, কিন্তু যদি মনের ভেতরে এই রীতি বেঁচে থাকে, তবে প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক, বাঙালির হালখাতা কখনোই হারাবে না তার সৌন্দর্য।