Trinamool Congress protests in Raniganj over drug price hike:-প্যারাসিটামল, এজিথ্রোমাইসিন, ইনসুলিন, থাইরয়েড ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ — এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ, কিন্তু এবার এইসব জীবন রক্ষাকারী ওষুধই যেন সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। ওষুধের পাইকারি মূল্যের সূচক মেনে ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ (NPPA) ওষুধের দাম ১.৭৪% পর্যন্ত বাড়ানোর সবুজ সংকেত দিয়েছে, আর তাতেই গোটা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক গভীর উদ্বেগ ও প্রতিবাদের সুর। আর এই প্রেক্ষিতেই শনিবার রানীগঞ্জের এতোয়ারী মোড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে এক জোরালো বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন রানীগঞ্জ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি রূপের যাদব। আশপাশের গ্রাম থেকে বহু সাধারণ মানুষ, মহিলা থেকে শুরু করে প্রবীণ নাগরিকরাও এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা হাতে প্ল্যাকার্ড, গলায় স্লোগান তুলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—“ওষুধ কিনতে না পারলে কি আমরা মরব?” সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর হতাশা যেন চোখে মুখে স্পষ্ট, কারণ এমনিতেই বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী, পেট্রোল-ডিজেল থেকে রান্নার গ্যাস, সব কিছুর দাম বেড়েছে, তার উপর যদি প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ওষুধও নাগালের বাইরে চলে যায়, তবে মানুষ যাবে কোথায়? রানীগঞ্জ শহরের এক প্রবীণ শিক্ষক সমরেশ মিত্র জানালেন, “আমি ডায়াবেটিস আর উচ্চরক্তচাপে ভুগছি, প্রতিদিন প্রায় ১২০০ টাকার ওষুধ লাগে।

এখন দাম যদি আরও বাড়ে, তাহলে বাঁচব কীভাবে?” তাঁর পাশেই দাঁড়ানো বছর পঞ্চাশের গৃহবধূ সোমা ঘোষ বললেন, “আমার ছেলেটার থাইরয়েডের সমস্যা, প্রতিদিন ওষুধ না দিলে স্কুলে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এখন দাম বাড়লে কি আমরা থামিয়ে দেব? বাচ্চার জীবন কি সরকারের কাছে এতটাই সস্তা?” এরকম শত শত মানুষের মুখে একটাই কথা — কেন্দ্র সরকারের এই সিদ্ধান্তে তারা বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। তৃণমূল কংগ্রেস এই আন্দোলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরতে চায়। রূপের যাদব বলেন, “এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের গায়ে কুড়াল চালানোর মত। আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নেমেছি, আর প্রয়োজনে আরও বড় আন্দোলনে যাব।” এদিনের বিক্ষোভে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যান্য স্থানীয় নেতৃত্ব যেমন নীলমাধব চ্যাটার্জী, কৌশিক মণ্ডল, আরতি দত্ত প্রমুখরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কণ্ঠেও ছিল একই সুর—“ওষুধের দাম বৃদ্ধি মানে গরিব মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া।” কেন্দ্র সরকারের যুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদনের খরচ ও কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে, তবে সাধারণ মানুষ এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, “সরকার যেভাবে কর্পোরেটদের সুবিধা করে চলেছে, সেখানে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য কোনও অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।” এদিকে বাজারে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্যারাসিটামলের মতো একটি সাধারণ জ্বর-ঠান্ডার ওষুধের দামও ১০-১২% পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে, ইনসুলিনের মূল্যবৃদ্ধিতে চিন্তায় ডায়াবেটিক রোগীরা। রানীগঞ্জের মেডিসিন দোকানদার রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনই বলছে, পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখে দাম শুনে ওষুধ না নিয়েই চলে যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের।” যেসব মানুষ দিন আনে দিন খায়, তাঁদের কাছে এই ওষুধ কিনে খাওয়াটা একপ্রকার বিলাসিতার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তৃণমূল কংগ্রেস জানিয়ে দিয়েছে, শুধু রানীগঞ্জ নয়, সারা রাজ্যজুড়ে এমন আন্দোলন চলবে। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ কলকাতায় বলেন, “এই মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সর্বস্তরে প্রতিবাদ করবে। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেব না।” শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন নাগরিক সমাজ, চিকিৎসক সংগঠন, এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ওষুধের দাম এমনভাবে বাড়লে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর চাপ পড়বে। এক তরুণ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দত্ত জানালেন, “আমার কাছে বহু রোগী আসেন যারা প্রেসক্রিপশন ফেলে দিয়ে বলেন সস্তার ওষুধ লিখে দিতে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয়। রোগের চিকিৎসায় বাধা পড়বে। মানুষ নিজের চিকিৎসা বন্ধ করে দেবে, যা আরও বড় বিপদের ইঙ্গিত।” এদিকে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি বলছে, তারা বাধ্য হয়েই এই মূল্যবৃদ্ধি করছে কারণ রা-ম্যাটেরিয়াল, আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। কিন্তু এর খেসারত যে সাধারণ মানুষকে দিতে হবে, তা বুঝতে পারছেন সকলেই। এই মুহূর্তে দেশে ৮৭২টি ওষুধ মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় রয়েছে, যার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, ইনসুলিন, হৃদরোগের ওষুধ, ক্যানসারের ওষুধ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। তারই মধ্যে এভাবে মূল্যবৃদ্ধি একটি অশনিসংকেত বলেই অনেকে মনে করছেন।

রানীগঞ্জের আজকের বিক্ষোভ ছিল সেই হতাশা, রাগ আর আশাহীনতার প্রতিচ্ছবি — মানুষ আর চুপ করে বসে নেই, তারা রাস্তায় নেমে এসেছে, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। “ওষুধ বাঁচার অধিকার, তা নিয়ে বাণিজ্য চলবে না”—এই স্লোগানেই আজ মুখর ছিল রানীগঞ্জের এতোয়ারী মোড়। সাধারণ মানুষের একটাই দাবি, “আমরা রাজনীতি বুঝি না, বুঝি শুধু বাঁচতে চাই, আর তার জন্য দরকার সস্তা ওষুধ, সহজ চিকিৎসা।” এই প্রতিবাদ কি শুধু একটি দিনের ক্ষোভ? নাকি এর পেছনে আছে আরও গভীর, সুদূরপ্রসারী প্রভাব? সময়ই বলবে, তবে এতটুকু স্পষ্ট—যতদিন না সাধারণ মানুষের ওষুধ সহজলভ্য হয়, ততদিন এই লড়াই থামবে না।