...
Monday, May 5, 2025
Google search engine
HomeDurgapujaপুরুলিয়ার নদীয়াড়ায় বাসন্তী পুজো

পুরুলিয়ার নদীয়াড়ায় বাসন্তী পুজো

Basanti Puja at Nadiyara in Purulia: পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত একটি ছোট গ্রাম নদীয়াড়া। পাহাড়, জঙ্গল আর লালমাটির ঘেরা এই গ্রামে বছরের একটা সময় যেন অন্যরকম ভাবে ধরা দেয়। চৈত্র মাসের শেষ লগ্নে, যখন গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হয়, ঠিক তখনই নদীয়াড়ায় শুরু হয় এক অভূতপূর্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব—বাসন্তী মায়ের পুজো। শুধু এই গ্রাম নয়, আশেপাশের গ্রাম, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ এই পুজোতে ভিড় করেন। কারণ, এই পুজো শুধুই এক ধর্মীয় আচার নয়, এটি নদীয়াড়া গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস, ইতিহাস, এবং অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। কথিত আছে, প্রায় দেড়শো বছর আগে এই গ্রাম ও তার আশপাশে ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল বসন্ত রোগ। সেসময় চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। অসহায় গ্রামবাসীরা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করেন, কেউ কেউ গ্রামের বাইরে গিয়ে আশ্রয় নেন। তখন এক সন্ন্যাসী বাবা গ্রামে এসে পরামর্শ দেন—মায়ের আরাধনা শুরু করতে। ওই রাতেই কয়েকজন গ্রামের মানুষ স্বপ্নে বাসন্তী মায়ের আদেশ পান, এবং পরদিনই তাঁরা শুরু করেন মায়ের পুজো। সেই থেকেই এই বাসন্তী পুজো শুরু। পরবর্তীতে এই পুজোর পরে রোগের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমে আসে, মানুষজন গ্রামে ফিরে আসেন, এবং ভগবতী মায়ের প্রতি এক অপার বিশ্বাস জন্ম নেয় সকলের মনে। সেই থেকে প্রতি বছর চৈত্র মাসের অন্তিম সাত থেকে দশমী পর্যন্ত চলে এই বাসন্তী পুজো।

এই উৎসবে শুধু বাসন্তী দেবীর পূজা নয়, তার সঙ্গে গ্রামজুড়ে থাকে মেলার আমেজ, যাত্রা, বাউল গান, কীর্তন, নাটক, কবিগান, ছৌ নাচ, এবং নানান লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান। স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের নামী শিল্পীরাও অংশ নেন এই উৎসবে। নদীয়াড়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রামলাল সর্দার বলেন, “ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, এই বাসন্তী পুজো আমাদের গ্রামের গর্ব। আমি আজও সেই প্রথম দিনটায় মায়ের পাট সাজাতে হাত লাগাই, যতদিন বাঁচব এটা করে যাব।” অন্যদিকে, গ্রামের যুবক রাহুল মাহাতো বলেন, “এই পুজোই আমাদের গ্রামের আত্মা। শহরে কাজ করি, কিন্তু এই সময়টা আমি গ্রামে থাকি মায়ের সেবায়। এটা শুধু পুজো না, আমাদের সংস্কৃতির উৎসব।” চারদিন ধরে চলে এই পুজোয় প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। নদীয়াড়ার পাশের জেলা বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, এমনকি ঝাড়খণ্ডেরও বহু এলাকা থেকে মানুষ আসেন এই বাসন্তী পুজো দেখতে। গ্রামের মাঠে বসে বিশাল মেলা, দোকান, নাগরদোলা, খাবারের স্টল, খেলনা, হস্তশিল্পের জিনিস ইত্যাদি নিয়ে উৎসব হয়ে ওঠে অনেকটা বড় শহরের মেলাকে হার মানানো। ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান ছাড়াও পরিবেশ সচেতনতা, নারী সুরক্ষা, নেশামুক্তি, কন্যাশ্রী, সবুজ অভিযান ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতামূলক নাটকও পরিবেশন করেন স্থানীয় যুব সংঘ ও বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এইভাবে ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে সামাজিক বার্তাও তুলে ধরেন বাসিন্দারা।

BASANTI PUJO

এই পুজো ঘিরে যেমন একটা আবেগ জড়িয়ে, তেমনি এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। চারদিনের জন্য নদীয়াড়ায় গড়ে ওঠে অস্থায়ী বাজার, বহু মানুষের ছোট ছোট ব্যবসা হয়, হোটেল, লজ, গাড়িচালক থেকে শুরু করে ফুল বিক্রেতা—সবারই রোজগার হয় এই সময়ে। স্থানীয় প্রশাসনও সহযোগিতা করে পূজোর সময় ট্র্যাফিক, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জল সরবরাহে যাতে কোনো রকম সমস্যা না হয়। এক স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য বলেন, “আমরা চেষ্টা করি যাতে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা না হয়। বাসন্তী মায়ের পুজো আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য, আমরা সবাই মিলে এটা সফল করি।” বাসন্তী মায়ের এই পুজো অনেকটা দুর্গাপুজোর মতই হয়—ঘট স্থাপন, অঞ্জলি, চণ্ডীপাঠ, সন্ধিপুজো, হোমযজ্ঞ, কুমারী পুজো ইত্যাদি নিয়ম মেনে পালন করা হয়। দশমীর দিন বিশাল মিছিলের মধ্য দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন হয় গ্রাম সংলগ্ন ছোট নদীতে। বিসর্জনের সময় আবেগে ভেসে পড়েন বহু মানুষ—কারো চোখে জল, কারো ঠোঁটে ভবিষ্যতের প্রার্থনা। এই ঐতিহ্যবাহী বাসন্তী পুজো রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও উদযাপিত হলেও নদীয়াড়ার পুজোর একটা আলাদা মাধুর্য আছে। এর ইতিহাস, বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতি ও মানুষের আন্তরিকতা—সব মিলিয়ে এই পুজো শুধুই একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটা নদীয়াড়ার মানুষের আত্মপরিচয়। যেভাবে পুরুলিয়ার গ্রামীণ সংস্কৃতি আজও এই পুজোর মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। সরকারের উচিত এই ধরনের লোকসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা, যাতে এই ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মেও বহমান থাকে। কারণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন মানুষকে আত্মিক শান্তি দেয়, তেমনি লোকসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমাজকে একত্র করে, ঐক্য গড়ে তোলে। পুরুলিয়ার নদীয়াড়ার বাসন্তী পুজো তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.