Saturday, April 12, 2025
Google search engine
Homeরাজনীতিঅন্যানো রাজনীতিযুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি

New US tariff policy poses risks to Bangladesh’s economy : সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নতুন শুল্ক নীতি ঘোষণা করেছেন, তা নিয়ে সারা বিশ্বে তৈরি হয়েছে এক ধরনের আর্থিক আতঙ্ক আর আলোচনা। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭% পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়েছে, যা আগে ছিল গড়ে ১৫%— অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। এটা একেবারে অকল্পনীয় ধাক্কা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য, কারণ আমাদের দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ, যার প্রায় ৮৫% রপ্তানি আয় আসে এই খাত থেকে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বড় বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এখন এই অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর কারণে সেই বাজার হঠাৎ করে প্রতিযোগিতা হারাতে বসেছে, যা শুধু বড় বড় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নয়, লাখ লাখ শ্রমিকের জীবনেও প্রভাব ফেলবে।

ঢাকার মিরপুরের গার্মেন্টসে কাজ করা একজন নারী শ্রমিক রুনা আক্তার বলেন, “আগে কাজ নিয়েই টেনশন ছিল, এখন তো শুনছি বিদেশে পণ্যই কম যাচ্ছে, তাহলে তো আমাদের চাকরিও ঝুঁকিতে।” শুধু শ্রমিক নয়, এই খাতে কাজ করা সরবরাহকারী, ট্রান্সপোর্টার, কাঁচামাল সরবরাহকারীসহ নানা স্তরের মানুষদের উপরেও এর প্রভাব পড়বে। অর্থনীতিবিদ ড. ফারহানা জামান বলছেন, “এই ধরনের একতরফা শুল্কনীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমাদের এখনই বিকল্প বাজার ও পণ্যের বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “একটা দেশের উপর নির্ভরশীলতা থাকলে, এমন সিদ্ধান্তে পুরো অর্থনীতিই ঝুঁকিতে পড়ে।” শুধু বাংলাদেশ নয়, এই শুল্ক নীতির আওতায় পড়েছে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনামও। বিশেষ করে ভিয়েতনামের উপর আরোপ করা হয়েছে ৪৬% শুল্ক, যা ইতিমধ্যেই সেদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে ধাক্কা দিয়েছে। কিছু দেশে এই শুল্কের হার ৫০% পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে এবং এটি একপ্রকার বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। ঢাকার একজন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা এত বছর ধরে মার্কিন বাজারে মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করছি, কিন্তু এখন এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আমাদের ক্রেতারা অন্য দেশে পণ্য নিতে শুরু করেছে।” এর ফলে পণ্য অর্ডার কমে যাওয়া, দাম কমিয়ে দিতে বাধ্য হওয়া, লাভ কমে যাওয়া এবং একপর্যায়ে কর্মী ছাঁটাই পর্যন্ত চলে যেতে পারে। সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

trump%2022012025 01

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা শুরু করেছি। পাশাপাশি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, রাশিয়া সহ নতুন বাজার খুঁজে বের করার কাজও এগিয়ে চলছে।” তবে এখানেই শেষ নয়, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সময় সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় আরও জোরালো করতে হবে। কারণ, একা ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিতে পারবে না, এবং একা সরকারও বাজার ধরে রাখতে পারবে না। তাই দুই পক্ষকেই পরিকল্পিতভাবে সামনে এগোতে হবে। আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো— আমাদের পণ্য বৈচিত্র্য। এতদিন বাংলাদেশ মূলত পোশাক খাতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে, কিন্তু এখন সময় এসেছে আইটি, কৃষি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন খাতেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার। কারণ, বাজারের মতো পণ্যের বৈচিত্র্য থাকলে এমন একক শুল্ক নীতির ধাক্কা থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যায়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাঁধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়েছে।

তারা যেন রপ্তানিকারকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, নগদ প্রণোদনা ও কর ছাড়ের ব্যবস্থা করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনাও এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ট্রাম্পের এই নীতির পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব শিল্প ও কর্মসংস্থান রক্ষার চিন্তা থাকলেও, এটি বিশ্বের বহু দেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দিনে এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববাণিজ্যে এক নতুন উত্তেজনার সূচনা করবে, যার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতির ওপর। ছোট ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রপ্তানিকারক পর্যন্ত এখন একটাই প্রশ্ন করছে — “এই ঝড় থামবে কবে?” এর উত্তর হয়তো সময় দেবে, তবে বাংলাদেশের জন্য এখনই সময় ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার। একদিকে কূটনীতি, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করা, এবং নতুন পণ্য ও বাজারে নজর দেওয়া — এই তিনটি দিকেই এখন জোর দেওয়া প্রয়োজন। এক কথায়, এই শুল্কনীতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কেবল একটি খাত বা একটি দেশের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ নয়। এই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এখনই ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নিতে হবে, না হলে এই চ্যালেঞ্জ আরও বড় বিপদের রূপ নিতে পারে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments