Bhimi Ekadashi fair: নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাস এলাকা প্রতিবছর ভৈমী একাদশী তিথিতে এক অনন্য মহোৎসবের সাক্ষী হয়। এখানকার শিব মন্দির, যেখানে এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবলিঙ্গ অবস্থিত, এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। ২৬২ বছর আগে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং সেই থেকেই এই মেলা তার স্বকীয়তা বজায় রেখে চলে আসছে। মেলার মূল আকর্ষণ শুধুমাত্র শিব মন্দিরে পূজা নয়, বরং সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের বিশ্বাসের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন।ভৈমী একাদশীর মেলা শুরু হয় একাদশী তিথিতে এবং চলে শিবরাত্রি পর্যন্ত। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন শিব মন্দিরে জল ঢালতে ও শিবের আশীর্বাদ নিতে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বিশেষভাবে এই দিনে উপবাস রেখে মহাদেবের মাথায় জল ঢালার পর সেই জল পান করেন। এটি তাঁদের বিশ্বাস, এতে শরীর ও মন শুদ্ধ হয় এবং মহাদেবের কৃপা লাভ করা যায়।এই মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘মাইলোর খৈই’। এটি এমন এক ঐতিহ্য, যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। মন্দির প্রাঙ্গণে আসা প্রত্যেক ভক্ত এই খৈই সংগ্রহ করে নিয়ে যান এবং তা ভাগ করে নেন পরিবারের সকলের সঙ্গে। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই খৈই গ্রহণ করলে সংসারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।
বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামেই। এটি একটি প্রাচীন প্রথা, যেখানে রাজপরিবারের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মন্দিরের পুরোহিত স্বপন ভট্টাচার্য জানান, ‘ভৈমী একাদশীর দিনে শিব মন্দিরে জল ঢালার পর রাম-সীতা মন্দিরে সিঁদুর ও আলতা দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। এটি এক বিশেষ আচার যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।’শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, এই মেলা স্থানীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মেলায় নানা ধরনের দোকান বসে—হস্তশিল্প, পোশাক, প্রসাদ, মিষ্টি, খেলনা, নানারকম লোকজ সামগ্রী ইত্যাদি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এটি এক সুবর্ণ সুযোগ তাদের পণ্য বিক্রি করার। পাশাপাশি শিশুদের জন্য নানান ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে, যেমন নাগরদোলা, সার্কাস, ম্যাজিক শো ইত্যাদি। ফলে শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, এটি এক পারিবারিক মিলনমেলাও বটে।তবে, এত বড় মেলা পরিচালনা করা সহজ নয়। প্রশাসনের তরফ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশের নজরদারির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছতার দিকেও নজর দেওয়া হয়, যাতে কোনো রোগ ছড়িয়ে না পড়ে এবং সবাই সুস্থভাবে এই উৎসবে অংশ নিতে পারেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘ভৈমী একাদশীর মেলা আমাদের ঐতিহ্য। এটি আমাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা এই মেলার অংশ হয়ে আসছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।’ এক স্থানীয় দোকানদার বলেন, ‘এই সময় ব্যবসা ভালো হয়, যা সারা বছরের জন্য বড় সহায়তা।’ভবিষ্যতে, এই মেলাকে আরও সুসংগঠিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে। অনলাইন প্রচার, ডিজিটাল টিকিটিং, পর্যটন সংযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই মেলার জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রশাসনের তরফ থেকে আরও কিছু পরিকাঠামোগত উন্নতি করলে, এটি রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।এভাবে ভৈমী একাদশীর মেলা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও বহন করে। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, এটি এক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই মেলার প্রতিটি প্রহর সাক্ষ্য দেয় মানুষের আস্থা, ভক্তি এবং একতার।