Friday, April 18, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যভারতকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছিলেন মনমোহন সিং

ভারতকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছিলেন মনমোহন সিং

Manmohan Singh: মনমোহন সিং—একটি নাম, যিনি শুধু ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন নীরব কর্মযোগী হিসেবে স্মরণীয়। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৯১ সালে দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময় তিনি প্রমাণ করেছিলেন, নেতৃত্ব শুধুই ক্ষমতার নয়, তা দায়িত্ব ও দূরদর্শিতার মিশ্রণ। সম্প্রতি তাঁর প্রয়াণ শুধু রাজনৈতিক নয়, ভারতের আর্থিক স্থিতিশীলতার ইতিহাসে একটি যুগের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে।

ডঃ মনমোহন সিং-এর জন্ম ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, অধুনা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। দেশভাগের সময় পরিবার অমৃতসরে চলে আসে। ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধাবী এই মানুষটি কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পাঠ গ্রহণ করেন। জীবনের প্রথম অধ্যায়ে শিক্ষকতা এবং রাষ্ট্রপুঞ্জে কাজ করে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। এরপর বিভিন্ন সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত হন, যেখানে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা দেশকে একাধিক সংকট থেকে উদ্ধার করে।

Manmohan Singh Died 92 AIIMS Former PM India 1735233165678 1735233165931

১৯৯১ সালের আর্থিক সংকট ছিল ভারতের জন্য এক চরম সময়। দেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার শূন্যের পথে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কট একটি পরিচিত বিষয়। সেই সময় পিভি নরসিমা রাও তাঁকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তিনি উদার অর্থনীতির পথে দেশের বাজার খুলে দেন, যা ভারতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত শুধু দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেনি, বরং ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে শক্তিশালী অর্থনীতির স্বীকৃতি দেয়।

২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা দশ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শাসনকাল ছিল স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ। তিনি প্রথম অ-হিন্দু প্রধানমন্ত্রী এবং প্রথম অ-গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান। যদিও রাজনৈতিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন বারবার। বিরোধীরা তাঁকে ‘মৌনি মোহন’ বলে কটাক্ষ করত, কিন্তু তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।

মনমোহন সিংয়ের সাধারণ জীবনযাপন তাঁর নেতৃত্বগুণের আরেকটি দিক। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি বিলাসবহুল গাড়ির বদলে নিজের মারুতি ৮০০-তে যাতায়াত করতে আগ্রহী ছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কীভাবে তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন।

তাঁর নীরবতা এবং অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি শুধু রাজনৈতিক মহলে নয়, সারা দেশবাসীর কাছে একজন অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তি এবং ২০০৮ সালের আস্থা ভোটে তাঁর সাহসিকতা তাঁকে ‘সিং ইজ কিং’ তকমা এনে দেয়।

তবে দ্বিতীয় মেয়াদে দুর্নীতির অভিযোগ এবং রাজনৈতিক চাপ তাঁর জনপ্রিয়তায় প্রভাব ফেলে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পরে তিনি রাজনৈতিক জীবনে একপ্রকার নীরব থেকে যান। কিন্তু তাঁর কাজের জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন।

manmohan singh pti 2

ডঃ মনমোহন সিংয়ের প্রয়াণ একটি যুগের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে নেতৃত্ব মানে শুধু ক্ষমতা নয়, এটি দায়িত্ব, নিষ্ঠা এবং সততার এক বিরল মিশ্রণ। তাঁর এই অবদান ইতিহাসে চিরকাল জীবিত থাকবে।মনমোহন সিং-এর মৃত্যু শুধু ভারতীয় রাজনীতির নয়, একটি পুরো প্রজন্মের জন্য এক শোকের বার্তা। তাঁর সময়ে যে আর্থিক সংস্কার শুরু হয়েছিল, তা আজকের ভারতের অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তির মতো সাহসী সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়।

তাঁর নীতিগুলি শুধু অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করেনি, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর শাসনকাল ছিল সংযম এবং নীতির এক অমলিন উদাহরণ। বিরোধী শিবিরের ধারালো আক্রমণের পরেও তিনি কখনও পাল্টা বক্তব্য রাখেননি, বরং কাজের মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন।

তাঁর নেতৃত্বে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তি যেমন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল, তেমনই তাঁর আর্থিক নীতিগুলি দেশীয় অর্থনীতির ভিত শক্ত করে। নোটবন্দির মতো কঠিন সিদ্ধান্তের পরিণামের কথা উল্লেখ করে তিনি যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীতে বাস্তবতা হয়ে ওঠে।

মনমোহন সিং-এর নীরবতা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। তাঁর সমালোচকরা তাঁকে দুর্বল নেতা বলে কটাক্ষ করলেও ইতিহাস তাঁকে একজন দূরদর্শী এবং মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ হিসেবে মনে রাখবে। তাঁর শাসনকালে ভারতের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন দিশা পেয়েছিল।

আজ, তাঁর প্রয়াণে গোটা দেশ তাঁর স্মৃতিচারণ করছে। রাজনৈতিক মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ তাঁর অবদানকে সম্মান জানাচ্ছে। সারা দেশে তাঁর জীবন এবং কর্মের উদাহরণ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

তাঁর প্রয়াণে শুধু একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নয়, বরং ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার এক স্তম্ভকে আমরা হারালাম। এই শূন্যতা পূরণ করা কঠিন হবে, কিন্তু তাঁর আদর্শ এবং কাজের ধারাবাহিকতা আমাদের সামনে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

ডঃ মনমোহন সিং-এর জীবন আমাদের শেখায় যে নেতৃত্বের আসল অর্থ শুধুমাত্র বক্তৃতা নয়, কাজের মাধ্যমে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনা। তাঁর এই অমলিন অবদান ভারতের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments