Wednesday, April 16, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যপাঁশকুড়ায় প্রাচীন ঘানিতে উৎপাদিত হয় সরষের তেল

পাঁশকুড়ায় প্রাচীন ঘানিতে উৎপাদিত হয় সরষের তেল

Mustard oil is produced in ancient mines in Panshkura:প্রায় দেড়শ বছর আগে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চাউলখোলা গ্রামে শুরু হয়েছিল দাস পরিবারের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো। সময়ের প্রবাহে সেই পুজো আজও পালন করে আসছে চাউলখোলার দাস পরিবার, পুরনো রীতিনীতি মেনে, সমুদ্রের তীরবর্তী খড়ের আটচালায়। গল্পটা শুরু হয় ভগবান চন্দ্র দাসের সময়ে। চাউলখোলা তখন ওড়িশার রাজা দ্বারা শাসিত এলাকা ছিল এবং বসবাসের জন্য মোটেও উপযুক্ত ছিল না। তবে ভগবান চন্দ্র দাস দৃঢ় সংকল্প নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তাঁর ছেলে কুঞ্জবিহারী দাস ছিলেন মা দুর্গার একান্ত ভক্ত এবং তাঁর হাত ধরেই প্রথম শুরু হয় এই দুর্গাপুজো।

কুঞ্জবিহারী দাসের সময়ে উপকূলবর্তী প্রায় কুড়িটি গ্রামে দুর্গাপুজোর চল ছিল না, আর গ্রামবাসীরাও এমন এক মহোৎসবের জন্য অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন। সেইসব মানুষের আশা পূরণ করতে আটচালায় শুরু হয় মা দুর্গার পুজো। আটচালার মন্দিরে গড়ে তোলা হয় প্রতিমা, যেখানে দেবী দুর্গা বিরাজমান হয়ে আশীর্বাদ প্রদান করেন ভক্তদের। সেই সময় থেকেই এই পুজো চাউলখোলার মানুষের মাঝে এক বৃহৎ উৎসবের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে দাস পরিবারের প্রায় আড়াইশো জন সদস্য এই পুজোয় মিলেমিশে অংশ নেন এবং প্রত্যেকটি আয়োজনেই পরিবারের সদস্যদের সজাগ উপস্থিতি দেখা যায়।

38edea26 73d

দুর্গাপুজোর সময় বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন আলোকিত হয়ে ওঠে। নাচ, গান, নাটক সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে থাকে পরিবার এবং আশেপাশের মানুষজন। দাস পরিবারের পুজো এখন সর্বজনীন রূপ নিয়েছে, তাই শুধু গ্রামের মানুষ নয়, দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্তেরাও এই পুজোতে যোগ দেন। পর্যটকেরাও দীঘা ও মন্দারমনি যাওয়ার পথে এই পুজো দর্শনে আসেন। দেবীর কাছে মানত রাখেন অনেকেই, আর তা পূর্ণ হলে ফিরে এসে আবারও দেবীকে ধন্যবাদ জানান। এটি যেন শুধু একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান নয়, বরং সমগ্র অঞ্চল জুড়ে একটি সামাজিক মিলনমেলা।

আগে দশমীর দিন মায়ের মূর্তি সমুদ্রের জলে বিসর্জন দেওয়া হতো। বর্ষ পরিক্রমায় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে, বর্তমানে চাউলখোলা থেকে পিছাবনী পর্যন্ত এক জমজমাট সিঁদুর খেলা আয়োজন করা হয়। এরপর পরিবারের নিজস্ব দিঘিতে দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয়, যা পুজোর একটি প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামবাসীর জন্য এটি একটি বিশেষ সময়, কারণ দেবী প্রতিমার সামনে সমবেত হয়ে তাঁরা তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন, দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন এবং একে অপরের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন।

চাউলখোলার দাস পরিবারের দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়, এটি স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সমাজের এক মেলবন্ধন রচনা করে। পুজোর দিনগুলোতে পরিবার এবং গ্রামবাসী একে অপরের সঙ্গে একত্রে মিলিত হন। সময়ের সাথে সাথে এই পুজোর আয়োজন আরও বৃহৎ হয়েছে, তবে পুরনো রীতি-নীতি ও আচার পালনের বিষয়ে দাস পরিবার এখনও কঠোর। পরিবারটির বর্তমান সদস্য শিবানী দাস বলেন, “আমাদের পুজো শুধুই দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতির প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য শ্রদ্ধার্ঘ্য। আমরা চাই এই পুজো আমাদের উত্তরসূরিরাও পালন করবে।”

পূজার আয়োজনে রয়েছে বিশাল বাজেট এবং প্রচুর শ্রম। পরিবারের সদস্যরা নিজেদের হাতে প্রতিমা তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। প্রতিমা তৈরির সময় থেকে শুরু করে পুজোর প্রতিটি কাজেই পরিবারের সকলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রতিমা তৈরির কাজটি শুরু হয় প্রায় একমাস আগে এবং পুজোর আগেই প্রতিমা সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে যায়। এই আয়োজনে বহু মানুষের পরিশ্রম লেগে থাকে এবং একে কেন্দ্র করে অনেক ছোট ব্যবসায়ীও লাভবান হন।

চাউলখোলার এই দুর্গাপুজো স্থানীয় মানুষের জীবনে এক নতুন উন্মাদনা নিয়ে আসে। প্রতিবছর এই পুজোকে ঘিরে বহু মানুষ প্রতীক্ষায় থাকেন। দেবীর মূর্তি, সাজসজ্জা এবং বিশাল আকৃতির আটচালায় সাজানো দেবীর আসন দেখতে স্থানীয় এবং দূরদূরান্তের মানুষ একত্রিত হন। এই পুজোর আয়োজন শুধু ধর্মীয় প্রার্থনায় সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি তাদের সামাজিক ঐক্যেরও প্রতীক। “আমাদের পরিবার এবং আশেপাশের গ্রামের মানুষজন এই পুজোয় একত্রে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। এটা আমাদের একটি বৃহৎ পরিবার বলে মনে হয়” – বলছিলেন শ্যামল দাস, দাস পরিবারের একজন প্রবীণ সদস্য।

144d34d0 bc1

এই ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা এখন আরোও বেশি অনুভূত হয়। কারণ এটি শুধু একটি উৎসব নয় বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ধারা, যা স্থানীয়দের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে। প্রতিমা বিসর্জনের পরে গ্রামের মানুষজন একসঙ্গে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন, যা পুজোর শেষ দিনের প্রধান আকর্ষণ।

চাউলখোলার দাস পরিবারের দুর্গাপুজো আজ শুধু তাদের পরিবারের উৎসব নয়, এটি সমগ্র অঞ্চলের সম্পত্তি। স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ এবং উত্তর প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই দুর্গাপুজোর এই ঐতিহ্য রক্ষা এবং স্থায়ী রাখার জন্য পরিবারটি তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এই অনন্য দুর্গাপুজো চাউলখোলার মানুষদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, আর তা নিয়ে তাদের গর্বও যথেষ্ট। আমাদের পূর্বপুরুষের হাতে গড়া এই দুর্গাপুজো আজও আমাদের গর্বিত করে। আমাদের এই পুজোর মাধ্যমে দেবীর আশীর্বাদ যেমন আমরা পেয়ে থাকি, তেমনি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই ঐতিহ্যকে বজায় রাখবে এই কামনা করি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments