Saturday, April 12, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্য৩৫০ বছরের রীতি মেনে কালীকে কাঁধে নিয়ে দৌড়

৩৫০ বছরের রীতি মেনে কালীকে কাঁধে নিয়ে দৌড়

Maldah kali pujo Kali dour in Malda: মালদহের চাঁচলের মালতীপুরে প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যা পেরোনোর পরের দিন আয়োজিত হয় এক অনন্য রীতি—কালী দৌড়। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে শুরু হওয়া এই ঐতিহ্য আজও মালতীপুরের মানুষ সগৌরবে পালন করে আসছে। চাঁচলের রাজা শরৎচন্দ্র রায় বাহাদুর এই প্রথা চালু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এলাকায় সম্প্রীতির বোধ আরও শক্তিশালী হবে। সেই সময় মালতীপুর অঞ্চলে শুধুমাত্র একটি মাত্র পুকুর ছিল যেখানে একসঙ্গে বহু প্রতিমা বিসর্জন হত। প্রতিযোগিতাটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল যে, যার কালী প্রতিমা অক্ষত থাকবে, সেই প্রতিমা হবে প্রথম বিসর্জন। প্রথাটি এমন এক উন্মাদনার সৃষ্টি করে যা এখনো মানুষকে ঐতিহ্যের শিকড়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

আজও এই প্রতিযোগিতার দিন মালতীপুরে মানুষের ঢল নামে। দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ এখানে ভিড় জমায় মা কালীর প্রতি তাদের ভক্তি নিবেদন করতে। এলাকাবাসীরা আটটি ভিন্ন কালী প্রতিমাকে কাঁধে নিয়ে ছোটেন, এগুলি হল বুড়ি কালী, চুনকা কালী, বাজারপাড়া কালী, আম কালী, হ্যান্টা কালী, হাট কালী, ও শ্যামা কালী। কাঁধে প্রতিমা নিয়ে মালতীপুর বাজার প্রদক্ষিণ করে কালীবাড়ির কাছের কালী দীঘিতে পৌঁছানোই দৌড়ের লক্ষ্য। প্রতিটি প্রতিমা ও তার দলে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস দেখতে হলে এই দিনে মালতীপুরে যেতে হবে।

Asansol Kali

মা কালীর এই দৌড়ের পেছনে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। কালী দেবী হিন্দুদের কাছে শক্তির প্রতীক, তিনি সমস্ত বিপদের নাশক এবং সর্বশক্তিমান মা। মা কালীর এক হাতে রক্ত মাখা তলোয়ার আর এক হাতে অসুরের মুণ্ড, যাকে তিনি ধ্বংস করেছেন, এটা প্রতীকী যে তিনি সব অপশক্তির বিনাশ করতে সক্ষম। কালো রঙে আবৃত এই দেবীর রূপ যেমন ভয়ংকর তেমনই সুরক্ষাকারী, তিনি তার ভক্তদের সবসময় রক্ষা করেন। কালী মূর্তির মুখে বেরিয়ে থাকা লাল জিহ্বা এবং গলায় মাথার মালা তার অপরাজেয় শক্তিরই প্রতীক। কালী পুজো উত্তর মালদহের মানুষদের কাছে এক গভীর ভক্তি ও বিশ্বাসের স্থান। এই দৌড়ের মাধ্যমে কালী মাতার প্রতি তাদের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস আরও প্রকাশিত হয়।

এই প্রতিযোগিতার আরেকটি মজার দিক হল, প্রতিমা অক্ষত রাখা নিয়ে রীতি। দৌড়ের সময় যদি কোন প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সেটিকে পরবর্তী ক্রমানুসারে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই নিয়ম শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার রীতিই নয়, বরং তা অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে এক গঠনমূলক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, যা এক সুস্থ পরিবেশে মানুষকে একত্র করে রাখে।

মালতীপুরে উপস্থিত এক প্রবীণ ব্যক্তি জানালেন, “এই রীতিতে আমাদের ছোটবেলায় যেমন উচ্ছ্বাস ছিল, আজকের প্রজন্মও তেমনই মুগ্ধ। এ শুধু এক প্রথা নয়, এটি আমাদের সম্প্রীতির বন্ধনকেও আরও মজবুত করে।” প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া এক তরুণ বলেন, “এই দৌড়ে অংশ নেওয়া মানে মা কালীকে নিজ হাতে রক্ষা করা, আর এটা করতে পারা আমাদের জন্য গর্বের।”

প্রতি বছর এই দিনটিতে মালতীপুরের বাজার ও আশেপাশে যেন মেলা বসে যায়। ছোটবড় দোকান, মিষ্টির স্টল, খেলার সামগ্রী এবং অন্য সবকিছু নিয়ে পুরো এলাকাটি এক উৎসবের আকার নেয়। দৌড় শেষ হওয়ার পর শুরু হয় বিজয় উদযাপন, যেখানে প্রতিমাগুলি বিসর্জন দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে মালদহের প্রায় সব মানুষের মধ্যে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা দেখা যায়।

প্রতিযোগিতার দিন মালতীপুরের পথগুলি শুধু দর্শকের ভিড়ে জমজমাট থাকে না, বরং এর সাথে থাকে নিরাপত্তার বাড়তি ব্যবস্থা। পুলিশ বাহিনী মোতায়েন থাকে, যাতে উৎসবের আনন্দে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, “এই রীতি আমাদের সংস্কৃতির অংশ, এবং আমরা এই ঐতিহ্য বজায় রাখতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট। নিরাপত্তার দিকটিও আমাদের অগ্রাধিকারে থাকে।”

তবে, আধুনিক সময়ে এসে এই রীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে এই দৌড় নিয়ে অতিরিক্ত উত্তেজনা কখনো কখনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অনেকের মতে, এই প্রথার পেছনের মূল উদ্দেশ্য সম্প্রীতি বজায় রাখা, কিন্তু অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব কখনো কখনো বিভাজন তৈরি করতে পারে। তবে, এই দৌড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বন্ধন এবং মা কালীর প্রতি গভীর ভক্তি এই আশঙ্কাগুলি থেকে মুক্ত করে।

এই ঐতিহ্যবাহী কালী দৌড় শুধু এক ধর্মীয় আচার নয়, এটি মালতীপুরের মানুষের জন্য গর্বের একটি অংশ। সময় যতই এগিয়ে যাক, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই দৌড়ের গল্প বয়ে নিয়ে যাবে এবং কালী মাতার প্রতি তাদের বিশ্বাস ও ভক্তি বজায় রাখবে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজন, ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে এই রীতি দেখেন এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক আনন্দ অনুভব করেন। এই প্রথা যেন মালতীপুরের ইতিহাসের অংশ হয়ে আজও জীবন্ত রয়েছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments