Air strike on hospital in Myanmar, 34 killed : মায়ানমার—দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ, দমন-পীড়ন আর সামরিক শাসনের আঁধারে ডুবে থাকা এক দেশ। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। পশ্চিম রাখাইন প্রদেশ সেইসব অগ্নিগর্ভ এলাকা—যেখানে আরাকান সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দখল বজায় রেখেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই, ডিসেম্বরের শেষে দেশের প্রথম নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সামরিক জুন্টা। কিন্তু ভোটের আগেই সাধারণ মানুষের উপর হামলা—মায়ানমারের অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও উন্মোচিত করে দিচ্ছে।
বুধবার রাতে হঠাৎ করেই আকাশ থেকে বোমা ঝরে পড়ল। লক্ষ্য—রাখাইনের ম্রাউক-ইউ শহরের একটি হাসপাতাল। রাত ৯টার কিছু পরে যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখনই সামরিক বিমানহামলায় মৃত্যু হল ৩৪ জনেরও বেশি মানুষের। আহত হয়েছেন অন্তত ৬৮ জন। আরাকান বাহিনীর স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ১০ জন রোগীর। বিস্ফোরণে হাসপাতালের ভিতর-বাহির পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চিকিৎসক, নার্স, রোগী, স্বজন—কেউই ছিলেন না নিরাপদ। স্থানীয়রা বলেন, কোথা থেকে বোমা এল, কিছুই বুঝে ওঠার সময় পাননি তাঁরা। মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে চিৎকার, ধোঁয়া আর আতঙ্ক।

মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ঘটনার বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। তাঁদের নীরবতা সন্দেহ আরও গভীর করেছে। অথচ সমাজ মাধ্যমে জুন্টা-পন্থী কয়েকটি অ্যাকাউন্ট দাবি করেছে—এ হামলা নাকি সাধারণ মানুষের উপর নয়; উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে নিশানা করা। কিন্তু হাসপাতালে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠতে থাকা নিরীহ মানুষের লাশ—বিভিন্ন সূত্রের সেই দাবি মেলাতে পারছে না। এদিকে আগামী ২৮ ডিসেম্বর দেশের প্রথম নির্বাচনের ডাক দিয়েছে জুন্টা সরকার। তাঁরা বলছেন—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ খুলতে এই ভোট জরুরি। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার, লেখালিখির জন্যও নাগরিকদের শাস্তি, এবং বিক্ষোভে যুক্ত থাকার অভিযোগে সন্ধান-ওয়ারেন্ট—সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এ নির্বাচন আদৌ কতটা নিরাপদ বা স্বাধীন?

আরাকান বাহিনীর মুখপাত্র খাইং থুখা সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন সামরিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, “এটি সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী সেনাবাহিনীর সর্বশেষ নৃশংস আক্রমণ।” তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন—হামলার দায় কোনওভাবেই এড়াতে পারে না সামরিক জুন্টা। আহতদের বেশিরভাগই হাসপাতালে থাকা রোগী, যাদের কোনও রকম সংঘাতের সঙ্গে যোগ নেই। ম্রাউক-ইউ শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তীব্রভাবে। অনেকে বলছেন, যারা অসুস্থ, যাদের আশ্রয় হওয়ার কথা হাসপাতাল, তাদের উপর এমন আক্রমণ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। অনেকে আশঙ্কা করছেন, ভোটের আগে এ ধরনের দমনমূলক হামলা আরও বাড়তে পারে।

এই হামলা শুধু একটি হাসপাতালের উপর আঘাত নয়; এটি মায়ানমারের রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর সংকটের প্রতিফলন। সামরিক বাহিনী যেভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছে, তাতে নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়কে তারা আরও নিয়ন্ত্রণমুখী করতে চাইছে—এমন ধারণা বিশ্লেষকদের। রাখাইন প্রদেশ বহুদিন ধরেই আরাকান বাহিনী ও সামরিক জুন্টার সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু। হাসপাতালে হামলা তাই একদিকে সামরিক চাপ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখা হলেও, অন্যদিকে এটি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা আরও প্রকট করে তুলেছে। নির্বাচনের আগে এমন হামলা আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়াতে পারে।

সামরিক সরকার নির্বাচনকে স্থিতিশীলতার লক্ষণ হিসেবে তুলে ধরলেও, ঘটনাবলি ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে ভোটের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। সংঘাতমুখী রাখাইন অঞ্চলে আরও হামলার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আরাকান বাহিনী ইতিমধ্যেই জুন্টাকে দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ যদি আরও বাড়ে, তবে রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। ম্রাউক-ইউ হাসপাতালের উপর বিমান হামলা মায়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানবিক সংকটকে আবারও সামনে এনে দিয়েছে। যেখানে মানুষ সুস্থ হওয়ার আশায় হাসপাতালে যায়, সেখানে মৃত্যুের ছায়া নামিয়ে দেওয়া—এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা। নির্বাচনের আগেই এমন নির্মম আক্রমণ দেশের ভাঙা গণতন্ত্রের ছবি আরও স্পষ্ট করে তুলল।



