Red Fort blast, Burhan Wani’s revenge attack plan : দিল্লির হৃদয়স্থল লালকেল্লা—একদিকে ভারতের ঐতিহাসিক অহংকার, অন্যদিকে দেশের নিরাপত্তার প্রতীক। এমন জায়গার কাছেই ঘটে যাওয়া গাড়ি বিস্ফোরণ স্বাভাবিকভাবেই নাড়া দেয় গোটা দেশকে। প্রথমে অনেকে মনে করেছিলেন এটি হয়তো কোনও প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা। কিন্তু তদন্ত যত এগিয়েছে, ততই উঠে এসেছে এক চমকে দেওয়ার মতো, বহু পুরনো শেকড়ের সঙ্গে জড়ানো জঙ্গি ষড়যন্ত্রের গল্প। এই গল্পের শুরু ২০১৬ সাল থেকে। সেই বছরই নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মারা যায় হিজবুল মুজাহিদিনের কুখ্যাত কাশ্মীরি কমান্ডার বুরহান ওয়ানি। একসময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার উপস্থিতি, প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা তাকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির মুখপাত্রে পরিণত করেছিল। তার মৃত্যুর পর কাশ্মীর উপত্যকা উত্তপ্ত হয়েছিল বহুদিন। বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ—সেই স্মৃতি এখনো তাজা। তদন্ত সংস্থার মতে, সেই মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল সাম্প্রতিক দিল্লি বিস্ফোরণ।
তদন্ত সূত্রের খবর, লালকেল্লার কাছে বিস্ফোরণ ঘটানো আত্মঘাতী জঙ্গির নাম উমর উন নবি। তিনি কুখ্যাত “হোয়াইট কলার টেরর মডিউল”-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার পরিচিতদের কাছে সে নিজেকে ‘আমির’—অর্থাৎ নেতা বলে দাবি করত। সে বলত, গোটা মডিউল তার নিয়ন্ত্রণে, এবং সব বড় সিদ্ধান্ত তার অনুমতি ছাড়া হয় না। এই উমর উন নবিকেই সংগঠনের মধ্যে ‘আমির’ উপাধি দেয় মুজাম্মিল সাকিল। মুজাম্মিল বর্তমানে বিস্ফোরণ মামলার এক অন্যতম ধৃত জঙ্গি। সে জানিয়েছে, তাদের সংগঠনে সে যোগ দিয়েছিল মওলানা ইরাফান আহমেদের মাধ্যমে। মওলানা নিজেই নব্য সদস্য সংগ্রহ করতেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতেন, এবং ‘মডিউল’-এর কাজের ধরন শেখাতেন। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, দিল্লি বিস্ফোরণ কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি ছিল বহুদিন ধরে কষা পরিকল্পনা, যেখানে লক্ষ্য ছিল বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর বদলা। সেই সঙ্গে ভারতের রাজধানীতে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা তৈরি করাও ছিল উদ্দেশ্যের অন্যতম অংশ। তদন্তে উঠে এসেছে আরও এক নাম—শাহিন সঈদ। তাকেও পুলিশ জেরা করেছে। তার কাছ থেকেও মিলেছে বিস্ফোরণ পরিকল্পনা ও মডিউলের কার্যপ্রণালী সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এসব তথ্য একত্র করে পুলিশের হাতে এখন এক বিশদ নথিপত্রের সংগ্রহ। এসবই উদ্ধার করা হয়েছে হরিয়ানার ফরিদাবাদে হোয়াইট কলার মডিউলের সদস্যদের গ্রেফতারের পর।
তদন্ত সংস্থার বক্তব্য একেবারে স্পষ্ট—এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং কাশ্মীর থেকে রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সুচিন্তিত জঙ্গি পরিকল্পনার ফল। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং দিল্লি পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত চালাচ্ছে। বিস্ফোরণের পর থেকে লালকেল্লা ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি নজরদারি, ড্রোন টহল, বাড়তি ব্যারিকেড—সবকিছুই রাখা হয়েছে যাতে দেশের রাজধানীতে আর কোনওভাবে নিরাপত্তার ফাঁকফোকর তৈরি না হয়। সরকারি সূত্র বলছে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কেন্দ্র কোনওরকম আপস করতে রাজি নয়। কাশ্মীর থেকে দিল্লি—যেখানেই জঙ্গি মডিউলের অস্তিত্ব মিলবে, তা চিহ্নিত করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।

লালকেল্লার আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের কাছে এই বিস্ফোরণ যেন হঠাৎ আকাশভাঙা বিপদের মতো। অনেকেই বলেছেন, এরকম ঘটনা হবে তা ভাবতেই পারেননি। পর্যটক এবং স্থানীয় দোকানদাররা আতঙ্কিত। কেউ কেউ জানিয়েছেন, নিরাপত্তার কড়াকড়ি বাড়ায় তারা স্বস্তি পেলেও, মানসিক চাপ কাটাতে সময় লাগবে। একজন দোকান মালিক বললেন, “এখানে হাজার হাজার মানুষ আসেন প্রতিদিন। এটা যদি বড় বিস্ফোরণ হত, তাহলে কী হতো ভাবলেই ভয় লাগে।”
একজন পর্যটক বলেন, “আমরা দেশ-বিদেশের নানা জায়গা থেকে লালকেল্লা দেখতে আসি। এই ঘটনার পর মনে হচ্ছে নিরাপত্তা আরও বাড়াতে হবে।” বুরহান ওয়ানি—তাঁর নাম বহুদিন আগেই ভারতীয় সুরক্ষাব্যবস্থা এবং জঙ্গি সংগঠনের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। তার মৃত্যুর পর বহু জঙ্গি সংগঠন প্রতিশোধমূলক হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই দিল্লি বিস্ফোরণকে দেখছে তদন্তকারী সংস্থা। হোয়াইট কলার টেরর মডিউল—এই শব্দটি আবারও সামনে এল। নাম শুনে মনে হতে পারে কোনও পেশাদার, শিক্ষিত, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষদের নিয়ে গঠিত একটি জাল। আর এটাই এই মডিউলের ভয়ঙ্কর দিক—এরা চিরাচরিত অস্ত্রধারী জঙ্গির মতো নয়। এরা সমাজে মিশে থাকা সাধারণ মানুষের মতোই। চাকরি, ব্যবসা, পড়াশোনা—সবই থাকে। তাই তাদের চিনে বের করা অত্যন্ত কঠিন। তদন্তে উঠে আসা তথ্য বলছে, বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর প্রতিশোধ শুধু আবেগের প্রতিক্রিয়া ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক বার্তা দিতে চাওয়া, ভারতকে সতর্ক করতে চাওয়া এবং রাজধানীর বুকে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা। ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গোপনে তৈরি হচ্ছিল এই ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক।

দিল্লি বিস্ফোরণের তদন্ত এখনো চলছে। আরও কিছু গ্রেফতার হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে পুলিশ। হরিয়ানা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ফরিদাবাদে পাওয়া নথি বিশ্লেষণ করে আরও কিছু মডিউলের সন্ধানও মিলতে পারে। ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সামনে এটি একটি সতর্কবার্তা—জঙ্গিদের কৌশল বদলে যাচ্ছে, তাদের ছদ্মবেশ বদলে যাচ্ছে, কিন্তু উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে। তাই গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে আরও শক্তিশালী করাই হবে ভবিষ্যতের প্রধান লক্ষ্য। লালকেল্লার বিস্ফোরণ শুধু একটি ঘটনা নয়, এটি ভারতের নিরাপত্তার সামনে ছুঁড়ে দেওয়া এক কঠিন প্রশ্ন। দশ বছর আগের একটি মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এত বড় ষড়যন্ত্র—এটাই দেখিয়ে দেয় জঙ্গি সংগঠনগুলি কতটা জেদি, কতটা পরিকল্পনাবদ্ধ এবং কতটা নির্দয়।
তবে পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপ, তথ্য সংগ্রহ এবং জঙ্গি নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরার মাধ্যমে যে বার্তা উঠে আসে সেটি আশার—ভারত সতর্ক, প্রস্তুত এবং যে কোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। দেশবাসীর আশা, তদন্তের শেষে সত্য পুরোপুরি প্রকাশ পাবে এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি হবে।



