Tolipara stands by flood victims in North Bengal : দুর্গাপুজো শেষ হতে না হতেই উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রকৃতির রোষে বিপর্যস্ত জীবন। লাগাতার বৃষ্টি, নদীর জল বৃদ্ধি, আর সেই সঙ্গে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, ফসল, আশ্রয়। জলবন্দি মানুষদের মুখে আজও অনিশ্চয়তার ছাপ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে ত্রাণ কার্যক্রম। সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, সংগঠন, এমনকি সেলিব্রিটিরাও এগিয়ে আসছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
এই প্রেক্ষাপটে, কলকাতার টলিপাড়া — বাংলা চলচ্চিত্র জগতের হৃদয় — এবার সামনে এসেছে এক অনন্য মানবিক উদ্যোগ নিয়ে।
দুর্গাপুজোর পরদিনই সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। অভিযোগ উঠেছিল, যখন উত্তরবঙ্গ বন্যায় জর্জরিত, তখন তিনি কার্নিভালে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিতর্কের রেশ না টেনেই, নিঃশব্দে এক অন্য উদাহরণ তৈরি করলেন বাংলা সিনেমার এই ‘ইন্ডাস্ট্রি’ মানুষটি।কলকাতায় মঙ্গলবার আয়োজিত হয়েছিল “দেবী চৌধুরানী” ছবির বিশেষ প্রদর্শনী। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেব এবং প্রসেনজিৎ—দুই প্রজন্মের দুই তারকা, যাঁদের একসঙ্গে দেখা মানেই উৎসবের আবহ। কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যা শুধুই সিনেমার ছিল না, ছিল এক মানবিক বার্তার।এই প্রদর্শনীর মঞ্চ থেকেই তাঁরা ঘোষণা করেন—টলিউডের শিল্পী ও কলাকুশলীরা মিলে উত্তরবঙ্গের বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ তহবিলে ২০ লক্ষ টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেই অর্থ তুলে দেওয়া হবে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে, যাতে দ্রুত দুর্গত এলাকার মানুষদের কাছে সাহায্য পৌঁছানো যায়।

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, অন্যদিকে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সূত্রে খবর, সিনেমাজগতের এই উদ্যোগে সরকারের ত্রাণ বিতরণের কাজে বিশেষ সহযোগিতা করা হবে, যাতে দ্রুত অর্থ সঠিক জায়গায় পৌঁছায়। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা—জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, দার্জিলিং—জুড়ে যখন মানুষ ঘরছাড়া, আশ্রয়হীন, তখন টলিপাড়ার এই উদ্যোগ তাঁদের মনে এক অন্যরকম আশার আলো জ্বেলে দিয়েছে।

বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প বরাবরই সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ—প্রতিবারই সিনেমাজগত কোনো না কোনোভাবে পাশে থেকেছে সাধারণ মানুষের।তবে এ বারকার এই পদক্ষেপ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি এসেছে এমন সময়ে যখন টলিউডকে ঘিরে চলছে নানা সমালোচনা—‘গ্ল্যামার বনাম দায়িত্ববোধ’-এর প্রশ্নে। প্রসেনজিৎ ও দেবদের এই যৌথ উদ্যোগ সেই বিতর্কে এক ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে—মানুষের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত তারকাসুলভ আচরণ।অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই সহযোগিতা তাৎপর্যপূর্ণ। ২০ লক্ষ টাকা হয়তো বিশাল অঙ্ক নয়, কিন্তু এটি একতার প্রতীক। বহু তারকা, টেকনিশিয়ান, পরিচালক ও প্রযোজক একত্রিত হয়ে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রেখেছেন—এটাই আসল বার্তা।সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের এমন উদ্যোগ সাধারণ মানুষকেও অনুপ্রাণিত করে, যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ত্রাণকার্যে যুক্ত হন।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ মিলিয়ে উত্তরবঙ্গের পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। যেভাবে টলিপাড়া একত্রিত হয়েছে, তাতে আশা করা যায় অন্যান্য ক্ষেত্র থেকেও আরও সহানুভূতিশীল পদক্ষেপ আসবে।অভিনেতাদের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত মেলেছে, ভবিষ্যতে তাঁরা বন্যাদুর্গত শিশুদের জন্য শিক্ষাসামগ্রী, পোশাক ও খাদ্য সহায়তা পাঠানোর পরিকল্পনাও করছেন। সিনেমাজগতে ইতিমধ্যেই এই প্রসঙ্গে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের আলোচনা চলছে, যাতে সাহায্য আরও সংগঠিতভাবে পৌঁছানো যায়।
বিতর্ক, সমালোচনা, গ্ল্যামার—সব কিছুর উর্ধ্বে মানবতা। উত্তরবঙ্গের বিপর্যস্ত মানুষদের জন্য টলিপাড়ার এই নিঃস্বার্থ সহযোগিতা প্রমাণ করল, সিনেমা কেবল রূপালী পর্দার আনন্দ নয়, তা হতে পারে জীবনের আশ্রয়ও।প্রসেনজিৎ, দেব, এবং তাঁদের মতো শিল্পীরা দেখিয়ে দিলেন—সংকটের সময় নায়কত্ব কেবল গল্পে নয়, বাস্তবেও গড়ে তোলা যায়।বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই সংহতির বার্তা আজ গোটা রাজ্যের মানুষের মনে এক নতুন ভরসা জাগিয়েছে—
“সিনেমা শুধু পর্দায় নয়, মানুষের হৃদয়েও বেঁচে থাকে।”