Cyclone in the Bay of Bengal, water vapor entering the state:-বঙ্গোপসাগরের বুকজুড়ে আবারও প্রকৃতির খামখেয়ালি খেলা শুরু হয়েছে। মৌসুমী অক্ষরেখা সরে গিয়ে উড়িষ্যা উপকূল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেছে, আর তার জেরে তৈরি হয়েছে নতুন এক ঘূর্ণাবর্ত। এই ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে প্রচুর জলীয় বাষ্প ঢুকতে শুরু করেছে বাংলায়, আর সেই জলীয় বাষ্পই যেন গরমে জ্বলে-পোড়া দক্ষিণবঙ্গকে আরও বেশি অস্বস্তিকর করে তুলছে। সোমবার সকাল থেকে কলকাতার আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকলেও বৃষ্টির দেখা খুব একটা মেলেনি। এদিকে আবহাওয়া দফতর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—দক্ষিণবঙ্গে আপাতত গরম ও ঘামঝরানো পরিস্থিতি চলবে, সঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ সহ হালকা বা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ বুধবার থেকে বৃষ্টির মাত্রা কিছুটা বাড়তে পারে এবং ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কাও থাকবে। আবহবিদরা বলছেন, মৌসুমী অক্ষরেখার অবস্থান পরিবর্তন হওয়ার ফলে বাংলায় এই সময়ে বৃষ্টি কমে গিয়েছে, কিন্তু বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্ত নতুন করে জলীয় বাষ্প টেনে আনছে, ফলে সপ্তাহের দ্বিতীয় ভাগ থেকে রাজ্যজুড়ে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল।

কলকাতার মানুষজন ইতিমধ্যেই নাজেহাল, কারণ সোমবার শহরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ৩৪ ডিগ্রির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ৬৫ থেকে ৮৯ শতাংশ, যা গরমকে আরও অস্বস্তিকর করে তুলছে। দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলিও একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে—হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, দুই ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হলেও গরম থেকে তেমন স্বস্তি মিলছে না। এরই মধ্যে আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গের দুর্যোগ চলবে সপ্তাহ জুড়ে। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার এবং দুই দিনাজপুরে প্রবল বৃষ্টির সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সঙ্গে বইতে পারে ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়া। উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের জন্য এই বৃষ্টি যেমন আশীর্বাদ, তেমনই নদী ও পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীদের কাছে তা ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে।
ইতিমধ্যেই জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের গ্রামাঞ্চল থেকে খবর আসছে, অতিবৃষ্টির আশঙ্কায় মানুষজন চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় চাষিরা বলছেন, “বৃষ্টি হলে ধান-ভুট্টার চাষের জন্য ভালো হবে, কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে ফসলও নষ্ট হতে পারে। প্রতি বছরই এই সময়ে আমরা আতঙ্কে থাকি।” দক্ষিণবঙ্গের সাধারণ মানুষও এই অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছেন। অফিসগামীদের অভিযোগ, সকালে বেরোলেই জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে ঘামে, রাস্তায় যানজটের মধ্যেই হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটা গায়ে পড়ছে। আবার বৃষ্টি না থাকলে ঘাম আর গরমে দম বন্ধ হয়ে আসছে। এদিকে পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই ঘূর্ণাবর্তগুলি এখন আরও বেশি শক্তিশালী ও ঘন ঘন তৈরি হচ্ছে। তাদের মতে, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় এই জলীয় বাষ্পের চাপও অনেক বেশি হচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আবহবিদ জানালেন,

“যদি এই ঘূর্ণাবর্ত ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে, তাহলে তা নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। যদিও আপাতত সেই সম্ভাবনা নেই, তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরই সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে, ফলে সতর্ক থাকতে হবে।” কলকাতার রাস্তা, ফুটপাত, বাস-ট্রেন স্টেশন—সব জায়গায় এই অস্বস্তির আবহাওয়া নিয়ে চলছে সাধারণ মানুষের আলোচনা। কলেজ স্ট্রিটে এক বই ব্যবসায়ী বললেন, “সারাদিন দোকানে বসে থাকা যায় না। ফ্যানের বাতাসে ঘাম শুকোয় না। আবার হঠাৎ বৃষ্টি এলে বই-খাতা বাঁচানো দায়।” মৎস্যজীবীদের জন্যও এই সতর্কতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও আপাতত দক্ষিণবঙ্গের মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি, তবুও দমকা হাওয়া ও উত্তাল সমুদ্রের আশঙ্কায় অনেকেই ভয়ে সমুদ্রে নামতে চাইছেন না। মেদিনীপুরের এক জেলে বললেন, “বৃষ্টি হলে মাছ ধরতে সুবিধা হয়, কিন্তু ঝড় হলে নৌকো নিয়ে বেরোনো যায় না। আমরা আবহাওয়ার খবর শোনার পরেই সিদ্ধান্ত নিই।” এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনও নড়েচড়ে বসেছে। প্রতিটি জেলায় সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে, নদী ও খালের ধারে বসবাসকারীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কলকাতায় পৌরসভা ইতিমধ্যেই ড্রেন পরিষ্কারের কাজে জোর দিয়েছে, যাতে হঠাৎ ভারী বৃষ্টি হলে জল জমে না থাকে। তবে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, প্রতি বছরই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, কিন্তু স্থায়ী সমাধান হয় না। আবহাওয়া দফতর বলছে, এই সপ্তাহ জুড়ে আবহাওয়া একেবারেই স্থিতিশীল থাকবে না। কখনও গরমে নাজেহাল হতে হবে, আবার কখনও হঠাৎ বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানিতে ভিজতে হবে। ফলে বলা যায়, বঙ্গোপসাগরের এই ঘূর্ণাবর্ত রাজ্যবাসীর দিনযাপনে যেন নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছে। প্রকৃতির এই অস্থির খেলাই এখন মানুষের আলোচনার কেন্দ্রে। আসন্ন দিনগুলোতে যদি ঘূর্ণাবর্ত শক্তিশালী হয়, তাহলে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ উভয়কেই আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতে পারে।