AI stethoscope, the beginning of a new era in heart disease diagnosis!: নতুন যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান যেন সত্যিই এক অভাবনীয় দিগন্তে প্রবেশ করছে। চিরাচরিত সেই ডাক্তারবাবুর গলায় ঝোলানো কালো নলওয়ালা স্টেথোস্কোপকে আমরা সবাই চিনি। প্রায় ২০০ বছর ধরে মানুষের হৃৎস্পন্দন শোনার নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হয়ে আছে এটি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি বদলেছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান আরও নিখুঁত হতে চেয়েছে। আর সেই পথেই এবার এক বিস্ময়কর আবিষ্কার—“AI স্টেথোস্কোপ”, যাকে চিকিৎসকরা বলছেন হৃদ্রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা। লন্ডনে ইমপেরিয়াল কলেজের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এই ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ, যার নাম “Eko Duo Digital Stethoscope”। সাধারণ স্টেথোস্কোপ শুধু ডাক্তারকে হৃৎস্পন্দনের শব্দ শোনাতে সাহায্য করে, কিন্তু এই নতুন যুগের AI স্টেথোস্কোপ শোনার পাশাপাশি মুহূর্তেই রোগীর হৃদস্পন্দনের ইসিজি (ECG) করে ফেলে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সমৃদ্ধ অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেয়, রোগীর হৃদয়ে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না। ভাবুন তো, যেখানে আগে হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা, কিংবা দিন পেরিয়ে রিপোর্ট আসত, সেখানে এখন মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই রোগ নির্ণয় সম্ভব! এ যেন এক সত্যিকারের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ২০৫টি জেনারেল ক্লিনিকে ১৫ লক্ষেরও বেশি রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার রোগীর উপর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে AI স্টেথোস্কোপ। ফলাফল সত্যিই বিস্ময়কর। দেখা গেছে, চিরাচরিত পদ্ধতির তুলনায় এই AI স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করলে রোগীর হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ার সম্ভাবনা সাড়ে তিন গুণ বেশি।
অর্থাৎ, এতদিন যেসব সূক্ষ্ম সমস্যা চোখ এড়িয়ে যেত, এখন আর তা গোপন থাকবে না। বিশেষ করে যে রোগীরা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হৃদযন্ত্রের মারাত্মক সমস্যায় আক্রান্ত হন, তাঁদের ক্ষেত্রে আগেভাগেই সতর্ক হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে অগণিত প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের এক গবেষক জানিয়েছেন—“এই প্রযুক্তি হৃদরোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের হাতে এক অনন্য অস্ত্র হয়ে উঠবে। এটি শুধু নির্ণয়ের সময় কমিয়ে দেবে না, বরং গ্রামের ছোট ক্লিনিক হোক বা শহরের বড় হাসপাতাল—সব জায়গাতেই রোগীরা আরও সঠিক এবং দ্রুত চিকিৎসা পাবেন।” বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ডিজিটাল স্টেথোস্কোপে ব্যবহৃত মাইক্রোফোন এতটাই সংবেদনশীল যে, এমন সূক্ষ্ম শব্দও এটি ধরতে পারে যা সাধারণ মানুষের কানে ধরা পড়ে না। ফলে, এটি কেবল হৃদস্পন্দন নয়, হৃদপ্রকোষ্ঠের অস্বাভাবিকতাও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম। ভারতীয় চিকিৎসকদের মতে, যদি এই যন্ত্র ভারতে আসে, তবে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। যেখানে আজও অনেক সময় হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ ধরা পড়ে না, সেখানে একজন সাধারণ ডাক্তারও AI স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে রোগীকে দ্রুত সতর্ক করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, এই যন্ত্রের সঙ্গে ক্লাউড কানেকশন থাকায়, রোগীর ডেটা সরাসরি বড় হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠানো সম্ভব হবে। এতে করে দূরত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, প্রযুক্তি নির্ভর চিকিৎসায় মানুষের ভূমিকা কতটা কমে যাবে? চিকিৎসকরা অবশ্য পরিষ্কার করেছেন, এই স্টেথোস্কোপ ডাক্তারকে প্রতিস্থাপন করবে না, বরং চিকিৎসককে আরও শক্তিশালী হাতিয়ার দেবে। ডাক্তার এখনও রোগ নির্ণয়ের মূল ভূমিকায় থাকবেন, শুধু AI তাঁর কাজকে সহজতর করবে।
আর এই প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, চিকিৎসকরা তত দ্রুত ও নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারবেন। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই AI স্টেথোস্কোপ বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মারা যান। যদি এই প্রযুক্তি দ্রুত জনপ্রিয় হয়, তবে এই মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কমে আসবে। ভারতেও যেখানে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ হৃদরোগে প্রাণ হারান, সেখানে এই যন্ত্র হতে পারে জীবনরক্ষাকারী। তবে এটির দাম এবং সহজলভ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সাধারণ মানুষ যেন সহজে এটি ব্যবহার করতে পারে, সেই দিকেই নজর রাখতে হবে নির্মাতা সংস্থার। চিকিৎসক সমাজ মনে করছে, AI স্টেথোস্কোপ ভবিষ্যতের চিকিৎসাকে শুধু প্রযুক্তি নির্ভর নয়, বরং আরও মানবিক করে তুলবে। কারণ এটি রোগীদের আগেভাগেই সতর্ক করবে, ডাক্তারকে সময় দেবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার, আর পরিবারকে দেবে প্রিয়জনকে রক্ষা করার এক নতুন আশা। প্রযুক্তির এই ছোঁয়া মানুষের জীবনে যদি হাজারো হাসি ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে সেটাই হবে সত্যিকারের সাফল্য। আজ থেকে কয়েক বছর পরে হয়তো শিশুরাও বলবে—“ডাক্তারবাবু, আমার হার্ট চেক করবেন তো AI স্টেথোস্কোপ দিয়ে?”। সত্যিই, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই নতুন অধ্যায় একদিন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যাবে, যেন মনে হবে এটাই ছিল স্বাভাবিক।