Kalna’s Rakhi artists are working day and night: রাখিবন্ধন, এক ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, যা শুধু ভাইবোনের সম্পর্ককে নয়, সামগ্রিকভাবে মানবিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। প্রতি বছর শ্রাবণ পূর্ণিমায় রাখি বাঁধার এই ঐতিহ্য ঘিরে থাকে আবেগ, উৎসব আর শিল্পের ছোঁয়া। এই আবেগকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা এখন পরিণত হয়েছে এক শিল্পনগরীতে। যেখানে শিল্পীদের ঘাম ঝরে তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ রাখি। আর এবার সেই পরিশ্রমের সঙ্গী হয়েছে রাজ্য সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দপ্তর, যারা দিয়েছে রেকর্ড অর্ডার – ৬ লক্ষ ৬০ হাজার পরিবেশবান্ধব রাখি! এর জেরে শিল্পীদের মনে যেমন খুশির হাওয়া, তেমনই ঘামে ভেজা হাতে রাতদিন নিরন্তর চলছে রাখি তৈরির কাজ।গত এক সপ্তাহ ধরেই পূর্ব বর্ধমানের কালনার শিল্পীরা যেন নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছেন না। সকাল, দুপুর, রাত — সবটাই কাজের সময়। কারণ একটাই, সময় খুব কম, আর অর্ডার বিশাল। ২ অগস্টের মধ্যে এই বিশাল পরিমাণ রাখি পৌঁছে দিতে হবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। তাই ঘরে ঘরে চলছে রাখি তৈরির ধুম। কোথাও তুলো-কাগজ কাটা হচ্ছে, কোথাও রঙ মেশানো, কোথাও আবার সুতো বোনা চলছে পাটি পেতে। এমনকি বহু পরিবারের বয়স্ক সদস্যরাও এই কাজে হাত লাগিয়েছেন, যেন এক বিরাট মিলনমেলা তৈরি হয়েছে কাজের মাঝেও।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘কালনা উইভার্স আর্টিজান ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ শুরু থেকেই রাখি তৈরির বরাত পেয়ে আসছে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে। তবে এবারের মতো এত বড় বরাত আগে কোনওদিন পাননি বলে জানিয়েছেন সংস্থার সম্পাদক তপন মোদক। তাঁর কথায়, “এত বড় অর্ডার আগে কখনও আসেনি। এটা শুধু আমাদের সোসাইটির নয়, গোটা কালনা শহরের জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগ। অনেকেই এই বরাতের আয়ের উপর ভিত্তি করে সারা বছরের সংসার চালান।”রাজ্য সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দপ্তর থেকে পরিবেশবান্ধব রাখি তৈরি করে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগ শুধু এক শিল্পকলার সুরক্ষা নয়, বরং পরিবেশ সচেতনতা ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সরকারি তরফে জানানো হয়েছে, এই ধরনের পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করার মাধ্যমে সমাজে এক ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব এবং শিল্পীদের জন্য কর্মসংস্থানের পথও প্রশস্ত হবে।কালনার রাখি শিল্পীরা এই সময়টিকেই বছরের সবচেয়ে বড় মরসুম হিসেবে দেখেন। একজন মহিলা শিল্পী, যিনি গত পাঁচ বছর ধরে রাখি তৈরি করছেন, জানালেন, “আমরা সারা বছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করি। অন্য কাজের তুলনায় এখানে মজুরি একটু বেশি। তাই এই সময় বেশি করে কাজ করি। এবার অর্ডার এত বেশি যে এক মুহূর্ত ফুরসত নেই।”এই মুহূর্তে পূর্ব বর্ধমানের কালনা রাখি তৈরির দিক থেকে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ৬ লক্ষ ৬০ হাজার পরিবেশবান্ধব রাখির বরাত শুধু সংখ্যাতেই বড় নয়, এর মধ্য দিয়ে সমাজে পরিবেশ-সচেতনতা, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রবাহ এবং মহিলাদের কর্মসংস্থানের এক দুর্দান্ত নিদর্শন তৈরি হয়েছে। এছাড়াও, এই ধরনের উদ্যোগ আমাদের দেশীয় শিল্পকলাকে টিকিয়ে রাখতেও সহায়তা করছে।

এছাড়াও, কালনার এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছেন নানান বয়সের মানুষ। স্কুলপড়ুয়া থেকে গৃহবধূ, অবসরপ্রাপ্তরাও কেউ বাদ নেই। এর ফলে পরিবারভিত্তিক শিল্পচর্চার যে সংস্কৃতি আগে ছিল, তা আবার নতুন করে জেগে উঠছে।এবারের সাফল্য দেখে কালনার শিল্পীরা আশাবাদী যে ভবিষ্যতে এরকম আরও বড় বরাত আসবে। যদি এই প্রক্রিয়াটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে আরও বিস্তৃতভাবে পরিচালিত করা যায়, তাহলে শুধুমাত্র রাখি নয়, অন্যান্য হস্তশিল্প পণ্যের ক্ষেত্রেও কালনা রাজ্যের অন্যতম শিল্পকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। অনেকে চাইছেন, রাখির পাশাপাশি পুজোর আগে আলপনা, পটচিত্র বা বস্ত্রশিল্পেও এমন উদ্যোগ নেওয়া হোক যাতে কেবল এই মরসুমে নয়, সারা বছর ধরে কাজ থাকে।কালনার রাখি শিল্পীদের এই নিরলস পরিশ্রম এবং রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা মিলিয়ে এবারের রাখিবন্ধন শুধুমাত্র এক উৎসব নয়, বরং হয়ে উঠেছে আত্মনির্ভর ভারতের এক ছোট অথচ উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। এই গল্প শুধু রাখি তৈরির নয়, এই গল্প আত্মবিশ্বাসের, ঐক্যের, আর নিজভূমে দাঁড়িয়ে গর্ব করার। কালনার গলির একেকটি ঘরে যে রাখি তৈরি হচ্ছে, তার ভিতরে লুকিয়ে আছে শ্রম, স্বপ্ন আর স্বনির্ভরতার আলোকরেখা।