Police raid hotel in Santiniketan over honeymoon allegations : শান্তিনিকেতনের তালতোর এলাকায় বোলপুর-আমোদপুর রোডের ধারে ‘মা অ্যাপার্টমেন্ট’ নামে একটি হোমস্টে হঠাৎই রাতের অন্ধকারে আলোয় ভরে ওঠে—না, কোনো উৎসব নয়, বরং পুলিশের অভিযান। রবিবার মধ্যরাতে শান্তিনিকেতন থানার পুলিশের একটি বিশেষ দল সেখানে হানা দিয়ে উদ্ধার করে ৬ জন মহিলা, যারা দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিলেন নানা পরিস্থিতির চাপে। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় হোটেলটির মালিক ও ম্যানেজারকে। পরদিনই তাদের তোলা হয় বোলপুর মহকুমা আদালতে। রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন, যে ভূমিতে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শান্তির বাতাবরণ গড়ে তোলা হয়েছিল, সেখানে এমন কাণ্ড স্বাভাবিকভাবেই শোরগোল ফেলে দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গোপন সূত্রে খবর পেয়েই তারা এই অভিযান চালায়। তথ্য অনুযায়ী, এই হোমস্টের মালিক দীর্ঘদিন ধরেই বাইরে থেকে মহিলাদের এনে তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছিলেন এবং সেই সুযোগে গোপনে চলছিল দেহ ব্যবসার রমরমা। মহিলাদের দিনের পর দিন আটকে রেখে চালানো হচ্ছিল এই অনৈতিক কার্যকলাপ।
শুধু এই একটি হোটেল নয়, অভিযোগ আরও অনেক হোমস্টে, রিসোর্ট, এমনকি ছোট ছোট গেস্টহাউসেও চলছে একইরকম অবৈধ কার্যকলাপ, যা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকরা। শান্তিনিকেতন রাজ্যের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র—প্রতিদিন, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন বাংলার সংস্কৃতির স্বাদ নিতে, শান্তি ও প্রকৃতির ছোঁয়ায় কিছুটা সময় কাটাতে। সেই শান্তিনিকেতনেই যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে পর্যটনের ভবিষ্যৎই বা কোথায়? অনেকেই বলছেন, পর্যটনের আড়ালে আজকাল দালালচক্র শান্তিনিকেতনকে ‘রেড লাইট জোন’-এ পরিণত করতে চায়। স্থানীয় বাসিন্দা সরলা ঘোষ (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “আগে শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যা নামলে সবটাই নিস্তব্ধ হয়ে যেত। এখন দেখি রাত যত বাড়ে, ততই শব্দ, বাইক, অচেনা লোকেদের আনাগোনা বাড়ে। কিছু একটা তো ঘটছেই।”
পুলিশের এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এই এলাকায় বহু হোমস্টে বা রিসোর্টে নজরদারি প্রয়োজন। আমরা আগেই কিছু অভিযোগ পেয়েছিলাম। এবার গোপন সূত্রে নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালানো হয়েছে।” জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া মহিলাদের মধ্যে অধিকাংশই উত্তর ভারত ও বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, এবং তারা কোনও না কোনওভাবে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। ঘটনাটি সামনে আসতেই উত্তাল হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এতগুলো হোটেল, হোমস্টে কীভাবে দিনের পর দিন এই ধরনের অনৈতিক কাজ চালাতে পারে—কোথায় ছিল প্রশাসন, পর্যটন দপ্তর বা স্থানীয় প্রশাসনিক নজরদারি? জানা যায়, তালতোর, সোনাঝুরি, শ্যামবাটি, গোয়ালপাড়া সহ শান্তিনিকেতনের চারপাশে ছোট-বড় হোটেল ও হোমস্টের সংখ্যা অন্তত ২০০-এরও বেশি। এর মধ্যে অনেকগুলোতেই নিয়মিত লাইসেন্স চেকিং হয় না, পর্যটকের আইডি ঠিকমতো নেওয়া হয় না এবং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চালানো হয় অবৈধ ব্যবসা।
শুধু দেহ ব্যবসা নয়, অভিযোগ রয়েছে মাদকসেবন, হুক্কা পার্টি, অ্যালকোহল সাপ্লাই, এমনকি বাইরে থেকে আসা সন্দেহজনক গেস্টদের আনাগোনা নিয়েও। পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনার তদন্ত আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে। হোটেল মালিকদের ব্যাকগ্রাউন্ড, বুকিং পদ্ধতি, অতিথিদের ডিটেলস এবং লেনদেনের তথ্য খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য হোটেলেও অভিযান চালানো হবে। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে শান্তিনিকেতনকে স্বচ্ছ রাখতে প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিচ্ছে বলেই জানান এক আধিকারিক। স্থানীয় সমাজকর্মী ও শিক্ষক পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, “রবি ঠাকুর যে শান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছিলেন, তার আদর্শকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পর্যটন দরকার, কিন্তু তার আড়ালে যদি সমাজ বিকৃতি ঘটে, তাহলে আমরাই দায়ী হয়ে পড়ব ভবিষ্যতের কাছে।”
এদিকে, স্থানীয় হোটেল মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার জন্য সমস্ত হোটেল বা হোমস্টেকে দোষী মনে করা অনুচিত। প্রশাসনকে সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত।” তবে অনেকেই বলছেন, এই কথাগুলো আসলে মুখরক্ষা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ হোটেল ব্যবসায়ীরা নিজেরাই জানেন তাদের আশপাশে কী চলছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগামী দিনে প্রশাসনের তরফে কঠোর নির্দেশিকা জারি হতে পারে। সম্ভবত সব হোটেল-হোমস্টেতে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া ও অতিথিদের ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা হবে। স্থানীয় থানাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশও আসতে পারে। পাশাপাশি পর্যটন দপ্তরের তরফ থেকেও রুটিন চেকিং এবং সচেতনতা শিবিরের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, শান্তিনিকেতনের এই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলে, তার প্রভাব পড়বে শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, পর্যটনে—সব মিলিয়ে গোটা সমাজেই। প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের একটাই দাবি—এই ধরনের অনৈতিকতা যত দ্রুত সম্ভব নির্মূল হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ে এই ফাঁদে না পড়ে, আর শান্তিনিকেতন সত্যিই শান্তির প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।