Cancer hormonal test at the beginning of the rainy season: আজকের দিনে যখন চিকিৎসা খরচ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তখন রাজ্যের সাধারণ মানুষের জন্য এক বড় সুখবর নিয়ে এল বারাসাত মেডিকেল কলেজ। উত্তর ২৪ পরগণার অন্যতম স্বাস্থ্যকেন্দ্র বারাসাত মেডিকেল কলেজ এবার শুরু করল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অত্যাধুনিক হরমোনাল পরীক্ষা, বিশেষ করে ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া ও জটিল হরমোনজনিত সমস্যাগুলির নিরীক্ষায় ব্যবহৃত “ইলেক্ট্রোকেমলুমিনেশন” প্রযুক্তির মাধ্যমে। এতদিন অবধি এই ধরনের পরীক্ষা করাতে গেলে সাধারণ মানুষকে যেতে হতো বেসরকারি ল্যাবে কিংবা সেন্ট্রাল ল্যাবে, যেখানে খরচ হত হাজার টাকার ওপরে। কিন্তু এই নতুন ব্যবস্থার ফলে বহু পরিবার, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যারা এতদিন শুধুমাত্র অর্থের অভাবে চিকিৎসা শুরু করতেই পারেননি, তারা এবার বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। একসময় বারাসাত মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন হরমোনাল পরীক্ষা চলত “এলাইজা” পদ্ধতির মাধ্যমে, যা ছিল তুলনামূলকভাবে পুরনো ও ধীর। নতুন প্রযুক্তি “ইলেক্ট্রোকেমলুমিনেশন” অত্যন্ত নির্ভুল, দ্রুত ফলদায়ক এবং উন্নত মানের হওয়ায় অনেকটা সময় ও অর্থ বাঁচবে রোগীদের। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন থাইরয়েড, প্রোল্যাকটিন, পিএসএ, বিটা-HCG, ইনসুলিন, কোর্টিসল, LH/FSH, AMH, ক্যান্সার মার্কারসহ নানা ধরনের হরমোন টেস্ট করা সম্ভব, তেমনি ক্যান্সার রোগ শনাক্তকরণেও তা নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের উদ্যোগে এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরোক্ষ দৃষ্টি ও উৎসাহে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বলে জানান মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। বুধবার কলেজের একাডেমিক ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত সার্ভিস ল্যাবরেটরিতে সমস্ত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন হয়। মেশিন চালু করার প্রক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. সুহৃতা পাল, এমএসভিপি ডা. অভিজিৎ সাহা, ল্যাব ইনচার্জ, সিনিয়র ল্যাব টেকনিশিয়ান, জুনিয়র চিকিৎসক এবং বহু পড়ুয়া। ট্রায়ালের সময় সকলের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমএসভিপি ডা. সাহা বলেন, “আগামী সোমবার থেকেই সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে এই পরীক্ষার সুযোগ পাবেন। বিশেষ করে যাদের থ্যালাসেমিয়া, ক্যান্সার বা জটিল হরমোনাল সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মানুষ এই পরিষেবার সুবিধা নিতে পারবেন।” কলেজ সূত্রে খবর, দৈনিক প্রায় ৫০ থেকে ৭০টি নমুনা পরীক্ষা করা যাবে এই নতুন ল্যাবে। প্রতিটি রিপোর্ট ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মিলবে, যা আগে ৭-১০ দিন সময় লাগত। এই সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই খুশি সাধারণ মানুষ। সোনারপুর থেকে আসা বছর পঁচিশের ক্যান্সার রোগী তমালী সাহা জানালেন, “আগে কলকাতার প্রাইভেট ল্যাবে একবার টেস্ট করাতে ১৫০০ টাকা লাগত। এখন বারাসাতে বিনামূল্যে এই টেস্ট হওয়ায় আমার মতো বহু রোগী উপকৃত হবেন।” অন্যদিকে, কলেজের এক জুনিয়র ডাক্তার জানান, “এই প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা উভয়ের দিক থেকেই এক বিশাল অগ্রগতি। ছাত্ররা যেমন হাতে-কলমে শিখতে পারছে, তেমনি রোগীরাও পাচ্ছে উন্নত পরিষেবা।” মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. সুহৃতা পাল বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের কাছে সুলভে উন্নত পরিষেবা পৌঁছে দিতে। আজকে যে যন্ত্র বসানো হলো, তা হল Roche Cobas e411 মেশিন, যা বিশ্বমানের। এটি ব্যবহার করে এমন অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান এখনো রাজ্যে নেই।” চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল যেমন আগেই দেখা গেছে কোভিডের সময়, তেমনি এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে ক্যান্সারের প্রাথমিক ধাপে শনাক্তকরণ ও সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে বিশাল ভূমিকা নেবে। বর্তমানে ক্যান্সার ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১৪ লক্ষ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়, যার মধ্যে একটি বড় অংশেরই আর্থিক কারণে সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হয় না। তাই এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি বড় সামাজিক প্রতিশ্রুতি ও দায়িত্বের প্রতিফলন। ভবিষ্যতে যদি প্রতিটি জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে এমন প্রযুক্তি পৌঁছে যায়, তাহলে গোটা রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামো এক নতুন মাত্রা পাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর আগেও ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। এবার তারই একটি ধাপে যুক্ত হলো এই হরমোনাল টেস্ট প্রযুক্তির সংযোজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগের প্রাথমিক ধাপেই নির্ভুল পরীক্ষা হলে চিকিৎসার গতি যেমন বাড়বে, তেমনি কমবে মৃত্যুহার। রাজ্যের অন্য মেডিকেল কলেজগুলিও এখন এই বারাসাত মডেল অনুসরণ করে পরিকল্পনা নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও বর্ধমান মেডিকেল কলেজে এই প্রযুক্তি আনার কাজ শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগ শুধু এক হাসপাতাল নয়, বরং গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্যবোধ ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলার এই চেষ্টাই ভবিষ্যতের উন্নত বাংলার ভিত্তি গড়ে তুলবে। আজকের এই খবরে যেমন রয়েছে উন্নয়নের বার্তা, তেমনি রয়েছে আশার আলো—একজন দরিদ্র মানুষও যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করার নিরব প্রতিজ্ঞা।