No more first bench and last bench in schools, Avinab activities : দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘির বকুলতলা এফপি স্কুলে সম্প্রতি নেওয়া হয়েছে এক অভিনব উদ্যোগ, যেটি বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন দিশা দেখাচ্ছে। ‘ফার্স্ট বেঞ্চ’ আর ‘লাস্ট বেঞ্চ’ – এই দুই শব্দ আজও বহু ছাত্রছাত্রীর মনে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি করে, আবার কাউকে কাউকে অকারণ অহংকারেও ভোগায়। কিন্তু এই বকুলতলা স্কুল তার শ্রেণিকক্ষগুলিকে সাজিয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণ নতুন রূপে।
আর সেই নতুনত্বের কেন্দ্রে আছে – গোলাকার বেঞ্চ বিন্যাস। হ্যাঁ, এখন আর কোনও সারি নেই, কোনও সামনে-পেছনের পার্থক্য নেই। সবাই গোল হয়ে বসছে, চোখে চোখ রেখে পড়ছে, কথা বলছে, শিখছে—সবাই একসাথে, একমঞ্চে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী সুজিত কুমার মাইতি জানালেন, “আগে প্রথম বেঞ্চে বসা আর শেষ বেঞ্চে বসা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা মানসিক চাপ তৈরি হত। কেউ ভাবত সে ভালো ছাত্র বলে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে, কেউ ভাবত সে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে বলে লাস্ট বেঞ্চে। কিন্তু এখন এই গোলাকৃতি বেঞ্চ বিন্যাসে সেই পার্থক্য আর থাকছে না। সবাই সমানভাবে অংশ নিতে পারছে ক্লাসে, আর মনোযোগও চোখে পড়ার মতো বেড়েছে।”
এই উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও অভিজ্ঞতা দারুণ ইতিবাচক। বাংলা শিক্ষার এই নতুন রূপে তাঁরা দেখছেন ছাত্রছাত্রীদের মুখে হাসি, চোখে আলো, আর পাঠে আগ্রহ। শিক্ষিকা মীনাক্ষী পাল বললেন, “আগে অনেক সময় দেখা যেত, পিছনের বেঞ্চে বসা ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে পিছিয়ে পড়ছে বা মনোযোগ হারাচ্ছে। এখন সবাই একে অপরের মুখোমুখি বসে, ফলে শুধু পড়াশোনা নয়, তাদের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়াও তৈরি হচ্ছে।” শুধু শিক্ষক-শিক্ষিকাই নয়, খুশি ছাত্রছাত্রীরাও। চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া কৃশানু বলল, “এখন আর কেউ বলছে না আমি লাস্ট বেঞ্চে বসি। সবাই একসঙ্গে পড়ছি, স্যার-ম্যাডামদের ভালোভাবে শুনতে পাচ্ছি। ক্লাসও অনেক মজার হয়ে গেছে।” তারই সহপাঠী স্নেহা জানায়, “আগে তো লাস্ট বেঞ্চ মানেই মানসিকভাবে একটা পিছিয়ে থাকার ভাব। এখন মনে হচ্ছে সবাই একসাথে। আমি কথা বলতেও সাহস পাচ্ছি ক্লাসে।” এই পরিবর্তন যে শুধুই শ্রেণিকক্ষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব দেখেই।
শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শ্রেণিকক্ষে এই ধরণের সমতা-ভিত্তিক বসার বিন্যাস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলে। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা-র একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, “ক্লাসরুমে গোলাকার বা সমকেন্দ্রিক আসনের ব্যবস্থায় পড়ুয়াদের পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ে, শ্রবণ ও মনোযোগের মান উন্নত হয় এবং ক্লাসরুম পারফরম্যান্সে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।” শুধু তা-ই নয়, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-তেও (NEP 2020) বলা হয়েছে, শিক্ষাকে আরও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। বকুলতলা স্কুলের এই প্রয়াস সেই জাতীয় নীতির দিকেই যেন এগিয়ে চলেছে। স্থানীয় মানুষজনও এই উদ্যোগে দারুণ খুশি। গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যা মধুমিতা মণ্ডল বললেন, “এটা শুধু একটা স্কুলের নয়, গোটা গ্রামের গর্ব।
এই স্কুলের বদলের ছবি দেখে অন্য স্কুলগুলোতেও এমন ব্যবস্থা চালু হবে বলে আমরা আশা করছি।” খোদ রায়দিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক শ্রী প্রদ্যুৎ মণ্ডলও এই স্কুলের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে জানিয়েছেন, “বকুলতলা স্কুল যা করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। আমরা চাই, জেলায় আরও স্কুলে এই ধরনের উদ্যোগ হোক, যাতে শিক্ষার মান ও আগ্রহ – দুটোই বাড়ে।” স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই পরিবর্তনের জন্য খুব বড় কোনও আর্থিক খরচ হয়নি। পুরনো বেঞ্চগুলিকেই নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। বরং যা হয়েছে, তা হল একটি ভিশনের বাস্তবায়ন, যেখানে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী সমান, কেউ ‘ফার্স্ট’ বা ‘লাস্ট’ নয়।
এই ছোট উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে এক বড় শিক্ষা— মানসিকতার পরিবর্তনই আসল উন্নয়ন। এই গল্পটা শুধু একটা স্কুলের নয়, এটা এক নতুন মানসিকতার জন্ম দেওয়ার গল্প। যেখানে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু পাঠ্যবই নয়, আছে সম্মান, সমতা আর সহযোগিতা। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ একদিন হয়তো গোটা রাজ্যের, এমনকি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মুখ বদলে দিতে পারে। আগামী দিনে অন্য স্কুলগুলো যদি এই পথ অনুসরণ করে, তবে শুধুই একাডেমিক সাফল্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক সংহতির দিকেও এগিয়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।