Friday, July 11, 2025
Google search engine
Homeপশ্চিমবঙ্গআসানসোলমাইথন পাঞ্চেত থেকে জল ছাড়ল ডিভিসি

মাইথন পাঞ্চেত থেকে জল ছাড়ল ডিভিসি

DVC releases water from Maithon Panchet:-বৃষ্টি যতটুকু স্বস্তির, ততটাই ভয়ানক হতে পারে যদি তার পরিণতি হয় অতিরিক্ত জলসঞ্চয় আর তাতে জলাধার উপচে পড়ার পরিস্থিতি। আর ঠিক সেটাই হলো এই শুক্রবার, যখন ডিভিসি (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন) একযোগে মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে ছেড়ে দিল প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক জল। ডিভিসির বক্তব্য অনুযায়ী, টানা বৃষ্টির ফলে জলাধারগুলির জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে বেড়ে যায়। আর তাই মাইথন থেকে প্রায় ৩ হাজার কিউসেক এবং পাঞ্চেত থেকে ৫২ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা দামোদর ও তার সংলগ্ন নদী তীরবর্তী এলাকাগুলিতে। বিশেষ করে পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের তরফে ইতিমধ্যেই নীচু এলাকাগুলিতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।মাইথন ও পাঞ্চেত — দুই জলাধারই মূলত দামোদর অববাহিকার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন ১৯৪৮ সালে এই জলাধারগুলিকে বানানোর সময় থেকে এদের মূল লক্ষ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন। তবে বর্ষার সময় জলাধারগুলি জল ধারণের সীমা ছাড়িয়ে গেলে সেগুলি থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে জল ছাড়তেই হয়, নইলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ঠিক এই কারণেই ডিভিসি কর্তৃপক্ষ এই জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান এক শীর্ষ আধিকারিক। তাঁর ভাষায়, “এটা আমাদের কাছে প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত। জলাধারের ধারণ ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেলে বাঁধের গঠনগত ক্ষতি হতে পারে, যা গোটা অঞ্চলকে বিপদের মুখে ফেলবে। তাই জল ছাড়া হয়েছে, তবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ভাবে।”

1200 675 24403223 thumbnail 16x9 dvc aspera

এই মুহূর্তে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে দামোদর ও তার শাখা নদীগুলির জলস্তর। অনেক জায়গাতেই নদী উপচে পড়েছে, বিশেষ করে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোল, দুর্গাপুর, মেমারি, গুসকরা, ও খণ্ডঘোষ এলাকায় পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। পূর্ব বর্ধমান জেলার বড় portion এখনও কৃষিজমির উপর নির্ভরশীল। বর্ষার সময় এই জমিগুলি জলমগ্ন হলে শুধু ফসলই নষ্ট হয় না, বহু মানুষের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।পূর্ব বর্ধমান জেলার বাসিন্দা কৃষক শ্যামল ঘোষ বলেন, “জল যেভাবে বাড়ছে, তাতে ধান রোপার জমি ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা। জল যদি দু’দিন থেকে যায়, তাহলে গোটা মরসুমটাই মাটি।” একইসঙ্গে গুসকরার এক মৎস্যজীবী জানান, “আমাদের পুকুরে মাছ চাষ করা হয়, কিন্তু অতিরিক্ত নদীর জল ঢুকে গেলে পুকুর ভেঙে মাছ সব ভেসে যায়।”স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে খবর, সমস্ত নদীতীরবর্তী গ্রামগুলিতে পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। কোথাও কোথাও ইতিমধ্যেই এনডিআরএফ (ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স) ও সিভিল ডিফেন্সের টিম মোতায়েন করা হয়েছে। নদীর ধারে থাকা বাসিন্দাদের বলা হয়েছে প্রয়োজন হলে বাড়ি ছেড়ে স্কুল বা পঞ্চায়েত ভবনে অস্থায়ী আশ্রয় নিতে।

হুগলি ও হাওড়া জেলার অনেক এলাকাও দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে, বিশেষ করে আরামবাগ, ধনেখালি, সিঙ্গুর, বাগনান ও উলুবেড়িয়া। এইসব এলাকার বড় অংশ দামোদর বা রূপনারায়ণের শাখা নদীর ধারে হওয়ায় প্রতি বছরই জল ছাড়ার সময় জলমগ্ন হয়। এই বছর অতিরিক্ত বর্ষণ ও একসঙ্গে এত পরিমাণে জল ছাড়ার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।ডিভিসির জল ছাড়ার ফলে নদীর পারের গ্রামগুলিতে ভয়, উদ্বেগ এবং অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট ও পাঁশকুড়া এলাকাতেও সতর্কতা জারি হয়েছে, কারণ এই এলাকাগুলিও অনেকটা জলনির্ভর এবং সেখানে আগে বহুবার হঠাৎ জল বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে তীব্র প্রভাব পড়েছে।হলদিয়ার এক পরিবেশ কর্মী সুমিত দে বলেন, “জলাধার থেকে হঠাৎ এত জল ছেড়ে দিলে শুধু নদী নয়, আশেপাশের পুকুর, খাল, জলাশয়, সব উপচে যায়। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা বিপদে পড়েন, ছোট ছোট খালবিল প্লাবিত হয় এবং নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।”

DVC

এই পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়েও বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি হতে পারে, অন্যদিকে জল জমে থাকলে রোগবালাই, বিশেষত জলবাহিত রোগ বাড়ার সম্ভাবনাও প্রবল।একটি ভালো দিক অবশ্য বলা যায় যে, ডিভিসি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আগেভাগেই জল ছেড়েছে এবং সতর্কতা জারি করেছে। ২০১৭ সালে জল না ছেড়ে শেষ মুহূর্তে বাঁধ খুলে দেওয়ায় হাওড়া ও হুগলির বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এবার সেই ভুল হয়নি, এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকেও প্রতিটি ব্লকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।তবে এই জল ছাড়ার পেছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে — বিদ্যুৎ উৎপাদন। মাইথন ও পাঞ্চেত বাঁধের টারবাইন চালানোর জন্য জল ছাড়া প্রয়োজন, আর বর্ষার সময় এই টারবাইনগুলি সম্পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হয় যাতে সারা রাজ্যের চাহিদা মেটানো যায়। কিন্তু জল ছাড়ার সঙ্গে পরিবেশ ও জনজীবনের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখাই ডিভিসি ও প্রশাসনের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।সার্বিকভাবে বলা যায়, জল ছাড়ার এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে জনমনে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তেমনই সচেতনতা ও প্রশাসনিক তৎপরতা কিছুটা স্বস্তিও দিয়েছে। এখন দেখার, আগামী কয়েক দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি কেমন হয়, বৃষ্টি যদি আরও বাড়ে, তবে ডিভিসিকে আবার জল ছাড়তে হতে পারে।জল যেমন আশীর্বাদ, তেমনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে অভিশাপেও পরিণত হতে পারে— আর তাই আজকের দিনে আমাদের সকলের উচিত সতর্ক থাকা, প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলা এবং একে অপরকে সাহায্য করা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments