মেজাজ হারিয়ে ক্লাস রুম ভাঙল গজরাজ : Gajraj lost his temper and broke the classroom রাতের অন্ধকার নামতেই শুরু হয় সেই অপ্রত্যাশিত অভিযান। ক্লাসরুমের ভিতর তখন নেই কোনো ছাত্রছাত্রী, কিন্তু তখনও সেখানে পড়ে ছিল মিড ডে মিলের চাল, ডাল, আলু, আর কিছু শুকনো সামগ্রী। ঠিক সেই গন্ধই টেনে এনেছিল বনাঞ্চলের বাসিন্দা এক গজরাজকে। ঘটনাস্থল জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের খুট্টিমারি এফ বি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নির্জন এই গ্রামীণ স্কুলে হঠাৎ হানা দেয় এক বিশাল দেহী জংলি হাতি। রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ স্কুলের প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকে পড়ে সে। তারপর গুঁড়িয়ে দেয় একটি ক্লাস রুমের একাংশ। দেওয়াল ভেঙে পড়ে, বেঞ্চ-ডেস্ক গুঁড়িয়ে মাটিতে। এই ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। শিশুরা নিরাপদে থাকলেও, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকা, এমনকি বন দফতরও।ঘটনার পরদিন সকালে স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনা রাভা জানান, “আমাদের মিড ডে মিলের চাল-ডাল, আলু রাখা ছিল একটি ক্লাসঘরে। হয়তো তারই গন্ধ পেয়ে হাতিটি এসেছিল। স্কুলের এক দিকের দেওয়াল প্রায় পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এটা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।” তিনি আরও জানান, বন দফতর ও শিক্ষা দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে। আপৎকালীন ভিত্তিতে স্কুলের অফিস ঘরটিকে এখন ক্লাস রুম বানিয়ে পড়াশোনা চালু রাখা হয়েছে। বর্তমানে স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৩। অধিকাংশই খুট্টিমারি ও মেল বনবস্তির আদিবাসী শিশু, যাদের একমাত্র শিক্ষার ভরসা এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি।
এই ঘটনায় চরম ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বনবস্তির এক বাসিন্দা দুলাল ওরাও বলেন, “প্রায়ই সন্ধ্যার পর হাতির দল আসে আশেপাশের এলাকায়, কিন্তু এইভাবে স্কুলে ঢুকে দেওয়াল ভেঙে দেওয়া আগে কখনও হয়নি। আমরা চাই, বন দফতর এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিক। না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।” অপর এক অভিভাবক মমতা মুন্ডা বলেন, “আমার মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আমরা গরীব মানুষ, এই স্কুলেই পড়িয়ে স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এখন তো প্রাণের ভয়!”এই ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং উঠে আসছে বনজ সম্পদের সীমাহীন সংকট ও হাতিদের খাদ্যের অভাবজনিত সঙ্কটের ভয়াবহ চিত্র। বন দফতরের এক আধিকারিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবস্থায় বলেন, “খরতাপ ও বর্ষার শুরুতেই অনেক হাতি খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ের দিকে চলে আসে। খুট্টিমারি অঞ্চলের জঙ্গল অত্যন্ত ঘন হলেও হাতির পছন্দের খাবার সেখানে কমে গেছে। ফলে মাঝেমধ্যেই তারা এমন হানা দেয়। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টার্গেট করা দুর্ভাগ্যজনক।” তিনি জানান, বন দফতরের পক্ষ থেকে গজরাজের গতিবিধির উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং স্কুলের আশপাশে ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।জলপাইগুড়ির জেলা শিক্ষা আধিকারিক শুভাশিস পাল বলেন, “ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। আপৎকালীন ভিত্তিতে ক্লাস চালু রাখা হয়েছে শুনে ভাল লাগছে। শিক্ষা দফতরের তরফে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে, স্কুল সংস্কারের প্রয়োজন হলে তাও করা হবে। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে দেখা হবে।”

এই ঘটনায় যে প্রশ্নটি সামনে এসে পড়েছে, তা হল—বনাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় স্কুল কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলে তার নিরাপত্তা কি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়? বনাঞ্চলের গন্ডি যেখানে স্পষ্ট নয়, সেখানে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কি নীতিগতভাবে সঠিক?পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এই ঘটনা নিছক গজরাজের মেজাজ হারানো নয়, বরং প্রকৃতির ভারসাম্য হারানোর প্রতিচ্ছবি। জঙ্গলের ভেতর খাদ্যের অভাব, জলাশয়ের শুকিয়ে যাওয়া, দখলদারি ও অবাধ বৃক্ষছেদন—সব মিলিয়ে হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসছে খাবারের খোঁজে। তারা জানে না কোথায় স্কুল, কোথায় দোকান, কোথায় মানুষের ঘর। তারা শুধু খিদে চেনে। আর সেই খিদের জ্বালায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ শিক্ষা, স্থানীয় মানুষের মানসিক শান্তি।এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই ত্রিস্তরীয় সমাধান—প্রথমত, হাতিদের যাতায়াতের রাস্তা বা করিডোর চিহ্নিত করে অবৈধ দখলদারি সরানো; দ্বিতীয়ত, বনাঞ্চলে পর্যাপ্ত জল ও খাদ্যের সংস্থান রাখা; তৃতীয়ত, সীমান্তবর্তী স্কুলগুলিকে বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে আনা এবং শিক্ষকদের প্রাথমিক বিপদ মোকাবিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া। শুধুমাত্র পোস্টার সাঁটিয়ে বনজন্তু সংরক্ষণ করা যায় না, চাই বাস্তব নীতিগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।শেষে বলা যায়, এই গজবাহিনীর ‘স্কুল অভিযান’ যেন প্রশাসনের চোখ খুলে দেয়। কারণ এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ক্ষতির অঙ্ক শুধুই দেওয়াল বা বেঞ্চ নয়, ক্ষতি হবে একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের। সময় এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে টানাপোড়েন না করে সহাবস্থান তৈরি করার। তবেই হয়তো আবার নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে স্কুলে আসতে পারবে খুট্টিমারির ছোট ছোট শিশুরা।