Saturday, July 5, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যশতাব্দীপ্রাচীন কমলা দেবীর পুজো পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায়

শতাব্দীপ্রাচীন কমলা দেবীর পুজো পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায়

Centuries-old Kamala Devi worship in Katwa, East Burdwan:পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া ১ নম্বর ব্লকের কামালগ্রামে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলে আসা কমলা দেবীর পুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে গ্রামের প্রাণ, বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক। এবছরও আসার নবমীতে সম্পন্ন হলো এই বিশেষ পুজো, যেখানে অংশ নিল গোটা গ্রাম তথা আশপাশের বহু ভক্ত ও দর্শনার্থী। গল্পটা শুরু বহু বছর আগে, যখন গ্রামেরই কমলা দিঘিতে মাছ ধরতে গিয়ে এক জেলের জালে উঠে আসে একটি সোনার মূর্তি। সেই অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী গ্রামের প্রবীণরা এখনও স্মৃতিচারণ করেন আবেগে ভরা গলায়। জেলে সম্প্রদায়েরই প্রবীণ সদস্য গণেশ মণ্ডল জানান, “আমার ঠাকুরদা আমায় বলতেন, যে মূর্তি উঠেছিল সেটা একেবারে ঝকঝকে সোনার ছিল, কেউ ভাবতেই পারেনি জালে দেবী ধরা পড়বে।” সেই মূর্তিটি তখনকার রায় পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যাঁরা দেবীর মাহাত্ম্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন একটি মন্দির। সেখানেই শুরু হয় শতাব্দীপ্রাচীন কমলা দেবীর পুজো।কালের নিয়মে সেই সোনার মূর্তিটি এক সময় চুরি হয়ে যায়। গ্রামবাসীদের কাছে তা ছিল এক গভীর আঘাত, এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে হাল ছাড়েননি কামালগ্রামের মানুষ। অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করে আবারও শুরু হয় পূজা, সেই আগের মতই ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আবেগ নিয়ে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, মা কমলা দেবী গ্রামের রক্ষাকর্ত্রী, তাঁর আশীর্বাদেই ফসল ভালো হয়, রোগবালাই দূরে থাকে, আর শান্তিতে কাটে জীবন। এবছরও পুজোর দিন কামালগ্রামে এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয়েছিল। সকাল থেকে ঢাকের বাদ্যি, ফুলের গন্ধ, ধূপের ধোঁয়া আর আরতির ধ্বনিতে মাতোয়ারা ছিল গোটা গ্রাম।

এই পুজোর এক বিশেষ অংশ হল দেবীর শোভাযাত্রা ও জলস্নান পর্ব, যেখানে মা কমলাকে বিশেষভাবে সাজিয়ে চতুরদোলায় চাপিয়ে গোটা গ্রাম পরিক্রমা করানো হয়। দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই ঐতিহাসিক কমলা দিঘির পাড়ে, যেখানে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় জলস্নান, যা দেখতে ভিড় জমে হাজার হাজার মানুষের। কাটোয়া ও নদীয়া, মঙ্গলকোট থেকে আসা বহু দর্শনার্থী এদিন অংশ নেন। স্থানীয় এক গৃহবধূ রুমা দত্ত বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকে এই পুজো দেখছি, এমন আনন্দ, এমন অনুভব কোথাও পাই না। মাকে দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত।”পুজো উপলক্ষে বসে গ্রাম্য মেলা, হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় ছেলেমেয়েরা নাচ-গান পরিবেশন করে, থাকে নাটক ও কবিতা আবৃত্তি। কামালগ্রামেরই ক্লাস টেনের ছাত্রী স্নেহা ঘোষ এবারে আবৃত্তি করে ‘কমলার মঙ্গলকাব্য’, যেটা শুনে দর্শকদের চোখে জল। মেলায় পেঁড়া, জিলিপি, খেলনা, মাটির জিনিস, সবজির চারা—সব কিছুই পাওয়া যায়। গ্রামের বাইরে থেকে আসা বিক্রেতারা বলেন, এই পুজোর সময় তাঁদের ব্যবসা সবচেয়ে ভালো হয়।পুজোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সচেষ্ট ছিলেন স্থানীয় প্রশাসন। কাটোয়া থানার ওসি সৌরভ বিশ্বাস জানিয়েছেন, “গ্রামবাসী এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আমাদের বিশেষ নজরদারি ছিল। মন্দির চত্বর, মেলাপ্রাঙ্গণ ও শোভাযাত্রার রাস্তায় আমরা পর্যাপ্ত ফোর্স মোতায়েন করেছি।” পাশাপাশি স্বাস্থ্য শিবির ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিল পঞ্চায়েত।

Screenshot 2025 07 05 133018

এই পুজোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ী ভোলা পাল বলেন, “পুজোর সময় আমার মাটির প্রদীপ আর ধুপকাঠির বিক্রি দ্বিগুণ হয়ে যায়। বছরের এই কটা দিনেই সবচেয়ে বেশি লাভ হয়।” একইসঙ্গে এই উৎসব গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখে নতুন প্রজন্মের কাছে।বাঙালির উৎসবের ইতিহাসে মা দুর্গা, মা কালীর সঙ্গে সঙ্গে এই কমলা দেবীর পুজো এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে। কারণ এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচরণ নয়, এটি একটি গ্রামীণ সামাজিক একতাবদ্ধতার প্রতীক। যেখানে ধর্ম, ইতিহাস, লোকবিশ্বাস, সাংস্কৃতিক চর্চা আর গ্রামীণ জীবনের স্পন্দন এক সুতোয় গাঁথা থাকে।এই পুজো থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় কীভাবে প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান করে আধুনিক সমাজে এগিয়ে যাওয়া যায়। সরকার যদি এই ধরণের লোকাচারিক উৎসবগুলিকে পর্যটনের সাথে যুক্ত করে উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে আসে, তাহলে কামালগ্রামের মতো ছোট ছোট জায়গাও হয়ে উঠতে পারে ঐতিহ্য পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু। ইতিমধ্যেই কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল এবং সংবাদমাধ্যম এই পুজো নিয়ে রিপোর্ট করেছে, যা আরও মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়িয়েছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments