Farakka Barrage disrupted by heavy traffic jam, drivers in trouble ; “রাত পোহালেও গাড়ি নড়ছে না, ক্লান্তি আর হতাশায় ভুগছে চালকরা!” — এই আর্তনাদ এখন ফারাক্কার জাতীয় সড়কের প্রতিটি কোণে কোণে। বুধবার রাত থেকে শুরু হওয়া তীব্র যানজটে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে ফারাক্কা ব্যারেজের রাস্তা। একদিকে ব্যারেজের বেহাল রাস্তাঘাট, অন্যদিকে হাজার হাজার লরি ও পণ্যবাহী গাড়ির লম্বা লাইন — সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের ফরাক্কা থেকে নতুন ডাকবাংলা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে এই যানজট তৈরি হয়েছে। স্থানীয় মানুষ থেকে দূরপাল্লার যাত্রী, ছোট গাড়ির চালক থেকে শুরু করে বিশাল লরির ড্রাইভার— কেউই রেহাই পাচ্ছেন না এই দুর্যোগ থেকে। রাজ্যের উত্তর অংশ এবং বিহারের সঙ্গে যুক্ত এই গুরুত্বপূর্ণ রুটে প্রতিদিন কয়েক হাজার গাড়ি চলাচল করে, বিশেষ করে ফরাক্কা ব্যারেজ পেরিয়ে। কিন্তু ব্যারেজের রাস্তাটির দুরবস্থা এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে গাড়িগুলি এক ইঞ্চিও নড়তে পারছে না।
বড় গর্তে হুইল আটকে যাওয়া, রাস্তায় জল জমে থাকা, খোয়া উড়ে যাওয়া এইসব সমস্যা প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলত, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা চালক ও সহকারীরা খাবার জল, প্রয়োজনীয় পরিষেবা, এমনকি বাথরুমের ব্যবস্থার অভাবে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন। এক লরি চালক হরিয়ানার বাসিন্দা করণ সিং জানিয়েছেন, “বুধবার রাত থেকে দাঁড়িয়ে আছি, আজ শুক্রবার দুপুর হয়ে গেল, গাড়ি এক ফুটও এগোয়নি। খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি, শরীরটা ভেঙে পড়ছে।” অন্যদিকে মালদা থেকে আসা একটি বাসের যাত্রী, বৃদ্ধা সাবিত্রী দাস বলেন, “চিকিৎসা করাতে যাচ্ছিলাম মুর্শিদাবাদে, কিন্তু আটকে গেছি, শরীরটা ভালো লাগছে না।” এই ধরনের পরিস্থিতিতে শুধু গাড়ি চালক বা যাত্রী নন, বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। পণ্য পৌঁছতে না পারায় মালামাল সময়মতো বাজারে পৌঁছচ্ছে না, যার ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফরাক্কা বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী জিয়াউল হক বলেন, “লরির মাল ঢুকছে না, রেশন ডেলিভারি আটকে গেছে, দোকান চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।” বিশেষ করে পচনশীল দ্রব্য যেমন সবজি, মাছ, দুধ ইত্যাদি বহনকারী গাড়িগুলি দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকায় মাল খারাপ হয়ে যাচ্ছে, যার দায়ভার কেউ নিচ্ছে না। এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো সুরাহার আশ্বাস শোনা যায়নি।
পুলিশ কেবল গাড়িগুলি সাইড করে রাখছে যাতে অ্যাম্বুলেন্স বা জরুরি গাড়িগুলি কোনোভাবে পার হতে পারে, কিন্তু স্থায়ী সমাধানের কোনও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “ব্যারেজের উপর গাড়ির অতিরিক্ত চাপ এবং পুরনো রাস্তাঘাট এই সমস্যা তৈরি করছে। দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি, তাই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।” ফরাক্কা ব্যারেজ, যা একদিকে জল নিয়ন্ত্রণ করে আবার অন্যদিকে এই অঞ্চলকে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে, সেই ব্যারেজের রাস্তাটি এখন কার্যত মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষার সময় এই রাস্তায় জল জমে গিয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ট্রাক মালিক সংগঠন, পরিবহন সংগঠন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিনিধি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে যাত্রীদের দুর্ভোগ তো আছেই, কিন্তু চালক ও খালাসিরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে।
একদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি দাঁড়িয়ে, অন্যদিকে নিরাপত্তার অভাব, খাবার নেই, জল নেই — এটা তো অমানবিক!” স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ, রাস্তার সমস্যার কথা বারবার প্রশাসনকে জানানো হলেও এখনো পর্যন্ত স্থায়ী কোনও সমাধান করা হয়নি। ফারাক্কার বাসিন্দা শিক্ষক রতন মণ্ডল বলেন, “প্রতিদিন সকালেই দেখি রাস্তা জ্যামে ভর্তি, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সময়মতো পৌঁছতে পারে না। অথচ সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।” বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি দ্রুত মেরামতের মাধ্যমে না সামাল দিলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ব্যারেজের উপর অতিরিক্ত লোডের কারণে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য একটি বিপর্যয়ের শামিল হবে। প্রস্তাব উঠেছে বিকল্প বাইপাস রুট তৈরি করার, বা ব্যারেজ রোডের স্থায়ী সংস্কার ও আধুনিকীকরণের। কিন্তু সেই প্রকল্প কবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। ফরাক্কার এই যানজট শুধুমাত্র একটি রাস্তার সমস্যা নয়, এটি একটি বড় প্রশাসনিক ব্যর্থতার চিত্র।
যেখানে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন বারবার ভেঙে পড়ছে, অথচ আমরা সেই পুরনো গর্ত মেরামতির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি। যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার এই সমস্যাটিকে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এমন যানজটের ভোগান্তি চলতেই থাকবে — এবং তার চাপ পড়বে আমাদের খাদ্য সরবরাহ, ব্যবসা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, এমনকি নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপরেও। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের দায়িত্ব যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের ব্যবস্থা করা।