Muhammad Yunus: বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা চলছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন উঠে এসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসক মহম্মদ ইউনুস। নোবেলজয়ী এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, যিনি ‘গ্রামীণ ব্যাঙ্ক’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার জনক হিসেবে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত, সেই ইউনুসই এবার প্রশাসক হিসাবে নিজের ব্যর্থতা, সেনার চাপ ও রাজনৈতিক পক্ষগুলির অসহযোগিতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ঢাকায় উপদেষ্টা বৈঠকে পদত্যাগের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন—এমনটাই দাবি বাংলাদেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’-র। বৃহস্পতিবার রাতেই এই খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক মহলে, এবং রাতারাতি ঢাকায় দেখা যায় এক অস্বস্তিকর উত্তেজনার ছবি।
ঘটনা শুরু হয়েছিল সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ারিতে। সেনা সূত্রে খবর, সেনাবাহিনী ও বিএনপি সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলি ইউনুসের প্রশাসনে অসন্তুষ্ট। অবিলম্বে নির্বাচন না হলে ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার হুমকি দেন সেনাপ্রধান স্বয়ং। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে ইউনুসের পদত্যাগের গুঞ্জন। রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম। নাহিদ পরে বিবিসিকে বলেন, “আমি নিজে ইউনুস সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, কাজ করতে না পারলে থেকে কী লাভ? চাপ এতটাই, যেটা আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।”

এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, ইউনুস কেবল প্রশাসনিক স্তরে ব্যর্থতা অনুভব করছেন না, বরং রাজনীতির বিভিন্ন স্তর থেকে যে ধরনের বাধা তিনি পাচ্ছেন, তার বিরুদ্ধে একপ্রকার আত্মসমর্পণের বার্তা দিতে চাইছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত জটিল। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরই ইউনুসকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান হিসাবে আনা হয়েছিল। তার পিছনে ছিল একটি বড় অংশের আন্তর্জাতিক সমর্থন ও কিছু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলের চাপে তৈরি হওয়া ঐকমত্য। তবে সেই ঐকমত্যের ভিত্তি যে নড়বড়ে, তা বুঝিয়ে দিল এই পদত্যাগ ভাবনা।
‘প্রথম আলো’-র প্রতিবেদন অনুসারে, বৃহস্পতিবার ইউনুস ঢাকায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে স্পষ্টই জানান, তিনি পদত্যাগ করতে চান। কারণ, প্রতিদিন ঢাকায় রাজনৈতিক মিছিল, অবরোধ, রাস্তা বন্ধ—এর ফলে প্রশাসন প্রায় অচল। সরকারের সংস্কার প্রকল্পগুলি নিয়েও কোনও দল ঐকমত্যে আসছে না। উপরন্তু, ইউনুস জানান যে, পুলিশ ও প্রশাসনকেও প্রভাবশালী দলগুলি ঠিকভাবে সহযোগিতা করছে না। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের কথা ভাবাও কঠিন। ভোট হলে ব্যালট ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটতে পারে, আর সেসব ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা ও আগ্রহ—উভয়ই প্রশ্নসাপেক্ষ।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, ইউনুসের এই পদত্যাগ ইচ্ছা একেবারে নির্ভেজাল নয়। এটি একটি কৌশলী চাল হতে পারে। যেহেতু তাঁর প্রশাসনে প্রকৃত কোনও সাফল্য দেখাতে পারেননি, এবং এখন সেনা ও বিএনপি-সহ একাধিক দলের চাপ ক্রমশ বাড়ছে, তাই ইউনুস হয়তো এই পদত্যাগ ভাবনার মাধ্যমে সহানুভূতি কুড়োতে চাইছেন। তাঁর যুক্তি—“আমি সংস্কারের জন্য এসেছিলাম, আর সেটা যদি করতে না পারি, তাহলে কুরসিতে থাকার মানে কী?”—শোনাতে খুব আন্তরিক লাগলেও বাস্তবে এটি একধরনের রাজনৈতিক চাপ কমানোর কৌশল বলেই মনে করছেন অনেকে।

ইউনুসের ব্যক্তিগত ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, তিনি কখনও সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। বরং একজন সমাজসেবী ও অর্থনীতিবিদ হিসাবেই তিনি পরিচিত। ২০০৬ সালেও তিনি নিজের রাজনৈতিক দল গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, তবে তা বেশিদূর এগোয়নি। তাঁর পরিচিতি বিশ্বে ছিল একজন “সুশীল” মুখ হিসেবেই। অথচ আজ, বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক মঞ্চে তিনিই মুখ্য চরিত্র। তিনি ছিলেন এক ‘সংস্কারের মুখ’। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সেই মুখই আজ ক্লান্ত, হতাশ, চাপগ্রস্ত।
ঢাকার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল, সকলে এখন অপেক্ষা করছেন—ইউনুস আদৌ পদত্যাগ করবেন কি না। যদি করেন, তাহলে আগামী নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী প্রশাসন কীভাবে চলবে? কে হবেন নতুন মুখ? সেনা কি সত্যিই হস্তক্ষেপ করবে? নাকি বিএনপি নিজের পছন্দমতো কাউকে সামনে আনবে? এই সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনগণের মনে। আর অন্যদিকে, কিছু মানুষ মনে করছেন, ইউনুস যদি সত্যিই সরে দাঁড়ান, তাহলে তার প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক মহলেও। কারণ, তাঁর নামটাই ছিল আন্তর্জাতিক স্তরে গ্রহণযোগ্যতার প্রতীক।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কার্যত অন্ধকারে। শাসনক্ষমতা কে পাবে, কীভাবে নির্বাচন হবে, সেনা কী ভূমিকা নেবে—সবটাই অনিশ্চিত। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও পরিষ্কার একটা কথা উঠে আসছে—ব্যক্তিগত সদিচ্ছা, সৎ ভাবনা আর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও, বাস্তব রাজনীতির কাদামাটিতে নেমে কাজ করা এত সহজ নয়। ইউনুস হয়তো সেটাই এবার হাড়ে হাড়ে বুঝতে শুরু করেছেন। আর তাই হয়তো বলেই ফেলেছেন—“থেকে কী করব?”