Harishpur is still facing landslide fears, complete housing is still elusive:-পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত অন্ডাল এলাকার ছোট্ট গ্রাম হরিশপুর আজ আর কোনো সাধারণ গ্রাম নয়—এ যেন এক অনির্বাণ আতঙ্কের নাম। মাটির নিচে চাপা পড়া স্বপ্ন, দোতলা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, এবং চোখে-মুখে ভয় আর ক্ষোভ নিয়ে বেঁচে থাকা কয়েক হাজার মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। ২০০০ সালের সেই ভয়াবহ ধসের পর থেকে এই গ্রামে আর কোনওদিন শান্তির সকাল ওঠেনি। একাধিক বাড়ি রাতারাতি তলিয়ে গিয়েছিল মাটির গর্ভে, নিঃশেষ হয়েছিল জীবনের ঘরবসতি। সেই থেকে আজ ২৪ বছর কেটে গেলেও পূর্ণবাসনের প্রতিশ্রুতি শুধু আশ্বাসেই আটকে, বাস্তবের মাটিতে তার ছায়াও পড়েনি।গ্রামের বাসিন্দা শান্তিলতা মিদ্যা বললেন, “প্রথমে ভাবছিলাম কিছুদিনের মধ্যে সরকার কিছু একটা করবে। কিন্তু আজ দুই দশক কেটে গেল, আমরা শুধু শুনেই চলেছি—দেওয়া হবে, দেখা হবে, ভাবা হচ্ছে। কিন্তু কিছুই হল না।”

এই গ্রামে প্রায় ১৫০০ জন ভোটার রয়েছেন, কিন্তু তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্তই মনে করেন। শুধু কথার ফুলঝুরি নয়, বাস্তবের মাটিতে কিছু হোক—এটাই তাঁদের একমাত্র দাবি। ধসের ভয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন, আবার যারা রয়েছেন, তারা প্রতিদিন নিজের ঘরের চারপাশে ফাটল, কাঁপুনি আর হঠাৎ শব্দ শুনে আতঙ্কে থাকেন। দিন নেই, রাত নেই, বাচ্চাদের পড়াশোনাও অনিশ্চিত—এই চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কেটে যাচ্ছে হরিশপুরের মানুষের দিন।২০০০ সালের ধস কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, তা ছিল গোটা গ্রামের জীবনে এক স্থায়ী দুঃস্বপ্নের সূচনা। ওই ঘটনার পর থেকেই ধীরে ধীরে ফাটল ধরতে থাকে মাটিতে, দালানে, মানুষের আস্থায়। জানা যায়, এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ইসিএল-এর কয়লাখনি উত্তোলন চলছিল, যার ফলেই ভূগর্ভস্থ শূন্যতা তৈরি হয়ে ধসের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অথচ এত বছরের পরও খনির সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো স্থায়ী পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার মোল্লা বলেন, “আমরা সরকারকে বারবার বলেছি, এইভাবে আর চলতে পারি না। ইসিএলের অফিসারেরা এসে বলেন—সব হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা তো দিনদিন মৃত্যুর মুখে ঢুকে যাচ্ছি!” শুধু তিনি নন, হরিশপুরের প্রতিটি গৃহস্থের চোখে যেন একটাই প্রশ্ন—”আমরা কি ভারতবর্ষের নাগরিক নই?”
এই পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীরা বারবার প্রশাসনের দারস্থ হয়েছেন। স্থানীয় বিধায়ক, ব্লক প্রশাসন, এমনকি জেলা শাসকের অফিসেও বহুবার ডেপুটেশন, মিছিল, লিখিত অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। প্রত্যেকবারই উত্তর এসেছে—“চেষ্টা চলছে”, “তদন্ত হচ্ছে”, “প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে”। কিন্তু দুই দশকেরও বেশি সময় কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত সেই তদন্তের কোনও পরিণতি দেখা যায়নি। ফলে সাধারণ মানুষের মনে জন্ম নিচ্ছে প্রশ্ন—এই ‘চেষ্টা’ আর ‘প্রস্তাব’ কি কেবল একটা ভোট পাওয়ার হাতিয়ার?এই পরিস্থিতির প্রতিবাদে হরিশপুরের মানুষ বিগত লোকসভা উপনির্বাচন এবং বিধানসভা নির্বাচনে ভোট বয়কট করেন। তাঁদের স্পষ্ট বার্তা—“যতক্ষণ না আমাদের পূর্ণবাসনের নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা ভোট দেব না।” এটি কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, এটি একটি অসহায় জনমানুষের চরম হতাশার প্রকাশ।গ্রামের স্কুল, বাজার, রেশন দোকান সবই যেন দাঁড়িয়ে আছে এক অস্থায়ী কাঠামোর ওপর। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক বিপ্লব দাস জানালেন, “ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় মন দিতে পারে না। সবসময় ভাবে, আজকে না আবার ধস নামে! একটা কাঁপুনি, একটা শব্দ—সব কিছু থেমে যায়।” এই ভয়ের পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠছে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—সরকার কি আদৌ এই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াবে? নাকি আরও কয়েক দশক এমনই কাটবে শুধুই আশ্বাসে ভর করে? পূর্ণবাসন মানে কেবল ঘরবাড়ি নয়, পূর্ণবাসন মানে জীবনের নিরাপত্তা, মানে শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবিকা—যা হরিশপুরের মানুষ এখন বঞ্চিত।বিশেষজ্ঞদের মতে, এই এলাকায় সতর্কতার সঙ্গে খনন কার্য পরিচালনা না করায় এবং পর্যাপ্ত মাটি ভরাট না করায় ধসের ঝুঁকি বহু গুণ বেড়েছে। ভূগর্ভে বড় ফাঁক তৈরি হওয়ায় মাটি প্রায়শই বসে যাচ্ছে। ভূবিজ্ঞানী ড. অরিন্দম মুখার্জি বলেন, “এই এলাকায় এখনই খনি বন্ধ করে ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ শূন্যতা পূরণ করতে না পারলে, আগামী দশ বছরে এটি পুরোপুরি বসে যেতে পারে।” অর্থাৎ শুধু হরিশপুর নয়, আশেপাশের অঞ্চলও এই বিপদের মুখোমুখি।অথচ এর মধ্যে আশার কিছু আলো দেখা গেছে সম্প্রতি। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে শোনা যাচ্ছে, একটি পূর্ণবাসন প্রকল্পের প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি হয়েছে, এবং তা রাজ্য সরকারকে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। যদিও কবে, কখন, কতজন উপকৃত হবেন—তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে হরিশপুরবাসী এখন আর কোনও আশ্বাসে ভরসা রাখতে রাজি নয়। তাঁরা চান, প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হোক অবিলম্বে।সব শেষে হরিশপুর যেন আজ এক নীরব প্রতিবাদের প্রতীক—যেখানে মানুষ না রেগে, না ভেঙে পড়ে, প্রতিদিন ঘর বাঁধে, চুলা জ্বালায়, সন্তান মানুষ করে—জানতে জানে আজকের দিনটা ধস নামল না বলেই বেঁচে আছি। এই ‘জিও আর মরো’ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে তাঁরা আজ একটাই দাবি তুলেছেন—“আমাদের পূর্ণবাসন দাও, আমাদের সম্মান দাও।”