6 killed in bus Maruti crash:এ যেন এক রবিবার সকালের বিভীষিকা। জীবন থেমে গেল এক মুহূর্তেই, আর ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ছয়টি পরিবার। নদীয়ার করিমপুর থানার অন্তর্গত কাঠালিয়া এলাকায় ঘটে গেল এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনা, যেখানে একটি বেসরকারি যাত্রীবাহী বাস ও একটি মারুতি ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন ৬ জন নিরীহ যাত্রী। এদের মধ্যে ছিলেন নারী, বৃদ্ধ এবং একজন কিশোর। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আরও একজন। স্থানীয় মানুষ এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সকাল প্রায় আটটা নাগাদ কলকাতা থেকে করিমপুরগামী একটি দ্রুতগতির বাস এবং উল্টো দিক থেকে আসা একটি মারুতি ভ্যান মুখোমুখি ধাক্কা খেলে ভ্যানটি প্রায় দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতটাই জোরালো ছিল ধাক্কা যে শব্দ শুনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে আসেন স্থানীয় মানুষজন। কেউ ভয়ে চিৎকার করতে থাকেন, কেউ আবার মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে থাকেন, কিন্তু কিছু মানুষ এগিয়ে যান উদ্ধারকার্যে।
ভ্যানটির ভেতর থেকে একের পর এক রক্তাক্ত দেহ বের করে তড়িঘড়ি করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তাররা জানান, তাঁদের কিছু করার নেই—ছয়জনের শরীরের বহু অংশ থেঁতলে গিয়েছে, অনেকেই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে যে বাসটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছিল এবং বাঁকে মোড় নেওয়ার সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। যদিও বাসচালক দুর্ঘটনার পরেই পালিয়ে যায়, পুলিশ তার খোঁজ শুরু করেছে। করিমপুর থানার এক অফিসার জানান, “আমরা ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিক প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। বাসের চালক পলাতক। আমরা তাঁর খোঁজ করছি। পাশাপাশি মারুতি ভ্যানটির রুটিন চেকআপ বা ব্রেক ফেল করেছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কৃষক নারায়ণ সাহা (৫৪), তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা সাহা (৪৮), কিশোর পুত্র দেবজ্যোতি সাহা (১৪), স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকা রীতা বিশ্বাস (৩৫), বৃদ্ধা শৈলবালা মন্ডল (৬২) এবং শ্রমিক নবকুমার দত্ত (৪১)। দেবজ্যোতির স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোতোষ সরকার কান্নাজড়িত গলায় বলেন, “সে ছিল খুব শান্ত ছেলে, লেখাপড়ায় ভালো, ফুটবলে দুর্দান্ত। কী নিষ্ঠুরভাবে ভগবান ওকে কেড়ে নিল!”
ঘটনার পর গোটা এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কাঠালিয়া বাজারে দোকানদার থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া—সকলেই আলোচনা করছেন এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নিয়ে। অনেকেই দাবি করেছেন, “এই রাস্তা বরাবরই দুর্ঘটনাপ্রবণ। এখানে কোনো স্পিড ব্রেকার নেই, রাতের আলোও ঠিকঠাক নেই। বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।” স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য কৃষ্ণপদ হালদার বলছেন, “আমরা বহুবার ব্লক অফিসে চিঠি দিয়েছি। এই রাস্তায় স্পিড ব্রেকার চাই, ট্রাফিক নজরদারি চাই। কিন্তু কেউ শোনে না।”
এদিকে, করিমপুর হাসপাতালের সুপার ডা. অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের হাসপাতালে আহতদের নিয়ে আসা হলে আমরা চেষ্টা করি তাঁদের বাঁচানোর। কিন্তু ছয়জনের শরীরে আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে তাঁদের আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। একজন রোগী এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে রয়েছেন।”
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজ্যজুড়ে এই ধরনের দুর্ঘটনা বাড়ার পিছনে রয়েছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অনুপযুক্ত রাস্তা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি এবং গাড়িগুলির মেরামতির অভাব। বিশেষ করে ছোট ভ্যান বা চারচাকার যাত্রীবাহী গাড়িগুলো অনেক সময় ন্যূনতম নিরাপত্তা নিয়মও মেনে চলে না। দুর্ঘটনার পরও চালকরা পালিয়ে যায় এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নদীয়া জেলা পরিষদের সদস্যা শর্মিষ্ঠা গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, “প্রশাসনকে অনুরোধ করছি—রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, সিসিটিভি লাগান, এবং ঘনঘন টহল দিন। কোনো মা যেন আর তাঁর সন্তানকে হারান না। আমরা চাই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।”
এই ঘটনার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। অনেকেই পোস্ট করেছেন নিহতদের ছবি, স্মৃতিচারণ করেছেন এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। কেউ লিখেছেন, “এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা প্রশাসনিক অবহেলার ফসল।” অনেকে আবার এই ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার বন্ধ ডাকার কথাও ভাবছেন বলে জানা গিয়েছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশবাহিনী। করিমপুর থানার ওসি নিজে উপস্থিত থেকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন যে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজ্য পরিবহন দপ্তরের তরফ থেকেও জানানো হয়েছে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস মালিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখন প্রশ্ন উঠছে—এই দুর্ঘটনা কি প্রশাসনের চোখ খুলবে? নতুন করে কি নজরদারি বাড়ানো হবে? নাকি আবার কয়েকদিন পর সব ভুলে যাবে মানুষ? আজ যে ছয়টি প্রাণ হারাল, তাঁদের পরিবারের দুঃখ কি কখনো মেটানো যাবে? আর কতো প্রাণ গেলে প্রশাসন সজাগ হবে?
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যে আবারও শুরু হয়েছে ট্রাফিক সংস্কার, রোড সেফটি এবং সরকারি গাফিলতির বিতর্ক। সময় এসেছে প্রশাসন, পরিবহন দপ্তর এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগে এমন দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। নাহলে ‘মৃত্যু’ কেবল সংখ্যা হয়ে থেকে যাবে, আর প্রতিদিনের খবরের পাতায় শুধুই দেখা যাবে, “আবার দুর্ঘটনা, আবার মৃত্যু”।