Homemade spices, no danger! : গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন গোটা বাংলা হাঁসফাঁস করছে, তখন আমাদের রান্নাঘরের খুব সাধারণ জিনিসগুলি নিয়ে উঠছে এক ভয়ংকর প্রশ্ন—আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত ঘরোয়া মশলাগুলিই কি আজ শরীরের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে? শিলিগুড়ি থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমান থেকে মালদা—প্রচণ্ড গরমে হাসপাতালগুলিতে হিটস্ট্রোক, ব্রেন স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশনের রোগী বেড়েই চলেছে। এবং ডাক্তারদের মতে, এর পিছনে যেমন গরম দায়ী, তেমনই দায়ী আমাদের রোজকার খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে রান্নায় অতিরিক্ত তেল-মশলা ব্যবহার। খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা একবাক্যে বলছেন—“এই তীব্র গরমে যত কম তেল-মশলা খাওয়া যায়, তত ভালো। কারণ কিছু ঘরোয়া মশলা শরীরের উপকারের বদলে, গরমে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।”

গরমে শরীর এমনিতেই ডিহাইড্রেটেড থাকে, তার উপর যদি অতিরিক্ত তেল-মশলা খাওয়া হয়, তবে শরীরে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়, রক্তচাপ ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যার ফলাফল ভয়ানক। এনআরএস হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. প্রীতম ঘোষ জানান—“আমরা প্রত্যেক দিন হাসপাতালে এমন রোগী পাচ্ছি, যাঁরা অজান্তে খাবারের মাধ্যমে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন। বিশেষ করে রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগীরা যদি অতিরিক্ত আদা বা দারচিনি খান, তাঁদের হাইপো বা হাইপারটেনশন হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, ব্রেন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও থাকছে।”
এই অবস্থায় জেনে নেওয়া দরকার, কোন কোন পরিচিত ঘরোয়া মশলা গরমে বিপদের কারণ হতে পারে—
দারচিনি: চায়ের কাপ হোক বা পোলাও-খিচুড়ি—বাঙালির রান্নায় দারচিনির ব্যবহার চিরকালীন। কিন্তু এই মসলার মধ্যে থাকা ‘Cinnamaldehyde’ নামক উপাদান অতিরিক্ত শরীরে গেলে শরীরে ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ, আপনি যদি ব্লাড প্রেসার, সুগার বা অন্য কোনও ওষুধ খেয়ে থাকেন, তখন অতিরিক্ত দারচিনির কারণে ওষুধের কার্যকারিতা অনেকটাই কমে যেতে পারে।
হলুদ: হলুদ এমন এক মসলা যা অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবেও পরিচিত। তবে তার মূল উপাদান Curcumin অতিরিক্ত শরীরে গেলে লিভারের এনজাইমের উপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে শরীরে ওষুধের বিপাক প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকী অতিরিক্ত হলে লিভার ফেলিওরের আশঙ্কাও থাকে। বিশেষত, যদি একই সঙ্গে গোলমরিচেরও অতিরিক্ত ব্যবহার হয়, তবে লিভারের উপর চাপ আরও বেড়ে যায়।
আদা: আদা ঠান্ডা লাগা বা পেটের গণ্ডগোলে কাজে এলেও অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে বিপদ ডেকে আনতে পারে। বেশি পরিমাণে আদা খেলে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে। যারা ডায়াবেটিসের ওষুধ খান, তাঁদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ কমে গিয়ে Hypoglycemia-র ঝুঁকি বাড়ে। অন্যদিকে, আদা রক্ত পাতলা করে দিতে পারে, যা রক্তক্ষরণ বা ক্লটিংয়ে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, রান্নায় যদি এক চিমটে করে এই মসলা ব্যবহার করা হয়, তবে সেগুলি ক্ষতিকারক নয়। সমস্যা তৈরি হয় তখনই, যখন আমরা এই মশলাগুলিকে ‘প্রাকৃতিক ওষুধ’ ভেবে প্রতিদিন চা, স্যুপ, বা ড্রিংকে অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করি।
জনস্বাস্থ্যের প্রভাব
এই গরমে পাড়ায় পাড়ায় হিটস্ট্রোক বা ব্রেন স্ট্রোকের খবর ছড়িয়ে পড়ছে। হাওড়ার বালিতে এক স্কুলশিক্ষক অজ্ঞান হয়ে যান বাজার থেকে ফেরার সময়। পরবর্তীতে জানা যায়, তিনি নিয়মিত আদা-চা এবং হলুদ-জল খেতেন, কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবকে “ডিটক্স ড্রিংক” বলা হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার এই তথাকথিত স্বাস্থ্য টিপস গুলির সঠিক কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
চিকিৎসা মহল থেকে পরামর্শ—এখনই সময় এসেছে “মডারেশন” বা নিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার। এছাড়া ফুড ব্লগার ও রন্ধনশিল্পী শ্রীমতী অনন্যা সেন বলেন—“রান্নায় স্বাদ আনার জন্য মসলা দরকার ঠিকই, কিন্তু তা যেন পরিমাণমতো হয়। বরং এখন এমন কিছু রেসিপি চালু করা উচিত, যেখানে টক-ঝাল-নুন কমিয়ে, শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।”
শুধু ব্যক্তিগত নয়, স্কুলে মিড-ডে মিল, সরকারি হাসপাতালে রোগীদের খাবার, এমনকি হোটেল-রেস্তরাঁয় রান্না নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। স্থানীয় পুরসভার স্বাস্থ্য আধিকারিক সুজিত দে জানান—“আমরা শিলিগুড়ি ও দার্জিলিং এলাকার বেশ কিছু হোটেল-রেস্তরাঁয় পরিদর্শন করেছি। অনেক জায়গাতেই দেখা গেছে, অতিরিক্ত তেল-মশলা ব্যবহার করা হচ্ছে, যা গরমে জনস্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। সচেতনতা না বাড়ালে আগামি দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
সাধারণ মানুষ কী করবেন?
১. প্রচণ্ড গরমে যতটা সম্ভব সেদ্ধ বা পাতলা ঝোলজাতীয় খাবার খান।
২. তেল, দুধ, ঘি, চিনিযুক্ত খাবার, পনির বা কড়া মশলাযুক্ত রান্না থেকে দূরে থাকুন।
৩. চা বা কফির পরিবর্তে দই, লেবুজল বা ছানার জল খান।
৪. বাজারে বর্তমানে ‘হেলদি ড্রিংক’ বা ‘হলুদ চা’ নামক অনেক বিকল্প আসছে—তা খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এই প্রসঙ্গে কলকাতার নামী নিউট্রিশনিস্ট ইশিতা দত্ত বলেন—“ঘরোয়া উপায়ে রোগ সারানোর ইচ্ছা ভালো, কিন্তু তারও একটা সীমা থাকা দরকার। প্রতিটি মশলার আলাদা রাসায়নিক গঠন রয়েছে। অতিরিক্ত কোনও কিছুই ভালো নয়। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও দেখে মশলার ডোজ বাড়িয়ে ফেলবেন না।”
অতএব, গরমে সুস্থ থাকতে শুধু ঠান্ডা পরিবেশ বা জল খাওয়াই নয়, রন্ধনশৈলীতেও আনতে হবে বদল। আর সবচেয়ে বড় কথা—প্রাকৃতিক উপাদান বলেই কোনও কিছু নির্দ্বিধায় অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। তা না হলেই উপকারের বদলে বিপদ ডেকে আনতে পারেন আপনি নিজেই।