TMC: একদিকে যখন বাংলার রাজনীতির আকাশে ক্রমশ জমাট বাঁধছে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের মেঘ, ঠিক তখনই বড়সড় সাংগঠনিক রদবদল করে চমক দিল তৃণমূল কংগ্রেস। শুক্রবার বিকেলে রাজ্যজুড়ে হঠাৎই পরিবর্তনের হাওয়া বইতে থাকে শাসকদলের অন্দরমহলে। বহু প্রভাবশালী নেতাকে সরিয়ে নতুন মুখদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, অনেক জায়গায় কোর কমিটিকে দায়িত্ব দিয়ে তৃণমূল কার্যত বুঝিয়ে দিল, এবার আর ঢিলে দেওয়ার সময় নেই, রণসজ্জা পাকাপাকি। কেউ বলছেন ‘পরিষ্কার বার্তা’, কেউ বলছেন ‘দলীয় ডিসিপ্লিনের কড়া পদক্ষেপ’, আবার অনেকে এটাকে দেখছেন দীর্ঘদিন ধরে চলা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দেওয়ার কৌশল হিসেবে। তবে সব মিলিয়ে এই রদবদল যে তৃণমূলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ছক কষার অংশ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তৃণমূল কংগ্রেস, ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এককালের কংগ্রেস নেত্রী মমতা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজের রাজনৈতিক দল গড়েন এবং ধীরে ধীরে সেই দল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ২০১১ সালে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল এবং তার পর থেকে বাংলার রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এই দল। বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। আর তাঁর ভাইপো তথা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলে ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’-এর ভূমিকায় আসীন।

এবার এই অভিষেকের তত্ত্বাবধানেই হয়েছে তৃণমূলের এই রদবদল। সূত্র বলছে, বেশ কিছুদিন ধরেই দলের অন্দরমহলে আলোচনা চলছিল জেলা সংগঠনে পরিবর্তন আনার। শেষমেশ একের পর এক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে যায়—দল আগামী নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। চলুন একঝলকে দেখে নেওয়া যাক কে বাদ, কে ঢুকলেন দলে নতুন নেতৃত্বে।
বীরভূম: অনুব্রত মণ্ডল, একসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা, যিনি একসময় বীরভূম জেলায় ‘একচ্ছত্র সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁকে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেলবন্দি। তাঁর জায়গায় কোর কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ সেখানে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, বরং সম্মিলিতভাবে জেলা চালাবেন নেতারা।
উত্তর কলকাতা: এখানেও চমক। দীর্ঘদিন ধরে দলের একনিষ্ঠ কর্মী ও সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তর কলকাতার সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে এখন কোর কমিটি দায়িত্ব সামলাবে। অনেকেই মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জেনারেশন শিফট’-এর অংশ।
দমদম ও ব্যারাকপুর: সাংগঠনিক দায়িত্ব পেয়েছেন সাংসদ পার্থ ভৌমিক। একাধিক আন্দোলন ও রণক্ষেত্রে সক্রিয় থাকা এই নেতা এই দায়িত্ব পাওয়ায় অনেকেই বলছেন, তৃণমূল এখন ‘ফিল্ড লিডার’-দের গুরুত্ব দিচ্ছে।
উত্তর দিনাজপুর: এখানকার নতুন চেয়ারম্যান হলেন চোপড়ার বিধায়ক হামিদুর রহমান। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ‘জেসিবি কাণ্ড’-এর অভিযোগ, তবুও তাঁকে গুরুত্ব দিয়ে নেতৃত্বে আনা হয়েছে। রাজনৈতিক মহল বলছে, অভিষেকের কাছের লোক বলেই তাঁকে এই পদ দেওয়া হয়েছে।

মালদহ: এখানে চেয়ারম্যান হয়েছেন বাবলা সরকারের স্ত্রী চৈতালি সরকার। এই সিদ্ধান্ত দলীয় পরিবারের প্রভাব ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে নেওয়া হয়েছে বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
বাঁকুড়া: সাংগঠনিক জেলার সভাপতি পদে বদল এনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সাংসদ অরূপ চক্রবর্তীকে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তারাশঙ্কর রায়। এটি পরিষ্কার বার্তা, দায়িত্বহীনতা বরদাস্ত নয়।
আরামবাগ: চেয়ারম্যান পদে আনা হয়েছে সাংসদ মিতালী বাগকে। ঘরের মেয়েই ঘর সামলাবেন—এই বার্তা মিলছে এখান থেকে।
বনগাঁ: চেয়ারম্যান করা হয়েছে সাংসদ মমতা বালা ঠাকুরকে। ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্যবাহী প্রভাব বজায় রাখতেই এই পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিষ্ণুপুর: অলোক মুখোপাধ্যায়কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সভাপতি পদ থেকে। যদিও তাঁর জায়গায় নতুন মুখ এখনও ঘোষণা হয়নি।
কাঁথি: পীযূষ পণ্ডা আগের মতোই জেলা সভাপতি থাকছেন। হয়তো এখানকার সংগঠন স্থিতিশীল বলেই কোনো রদবদল হয়নি।
তমলুক: অসিত চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় নতুন জেলা সভাপতি করা হয়েছে সুজিত কুমার রায়কে।
এই রদবদলের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনির্বাণ রায় বলছেন, “তৃণমূল এই রদবদলের মাধ্যমে একদিকে যেমন দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার বার্তা দিল, তেমনি আগামী নির্বাচনে কে কোথায় কতটা গুরুত্ব পাবেন, তারও ছক কষে ফেলল।” তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী দিনে আরও কিছু জেলায় রদবদল হতে পারে, বিশেষ করে যেখানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তুঙ্গে রয়েছে।
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, “এই পরিবর্তন হল দলের আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ। আমরা চাই যুবশক্তি, অভিজ্ঞতা ও নতুন ভাবনা একত্রিত হোক। বিজেপি ও বিরোধীদের মতো নিরর্থক কথার উত্তর কর্মক্ষেত্রে কাজ দেখিয়েই দেব।”
এই সাংগঠনিক রদবদলে দলের নিচু স্তরের কর্মীদের মধ্যে একদিকে যেমন কিছুটা হতাশা, তেমনি উৎসাহও চোখে পড়ছে। কিছু জায়গায় দেখা গিয়েছে, সরানো হওয়া নেতাদের অনুগামীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তবে দলীয় নেতৃত্বের তরফে বলা হচ্ছে, “এটা সময়ের দাবি, কাকে কোথায় বসালে ফল হবে সেটা নেতৃত্ব ভাল বোঝে।”
সব মিলিয়ে বলা যায়, তৃণমূল কংগ্রেস এখন একদম ‘ইলেকশন মোড’-এ। ২০২৬-এর ভোটে আবারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী করার লক্ষ্যে মাঠে নামছে দল। আর এই রদবদল সেই লক্ষ্যপূরণের এক বড় পদক্ষেপ। সময় বলবে এই কৌশল কতটা কার্যকর হলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃণমূলের এই পদক্ষেপ যে বাংলার রাজনীতিতে নতুন জোয়ার আনতে চলেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।