Scientists’ new breakthrough: gold made from lead!:-মধ্যযুগ থেকেই এক অলীক কল্পনার গল্প ঘুরপাক খাচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক আর স্বপ্নবিলাসী মানুষের মনে—সীসা থেকে সোনা তৈরি করা। সেই কল্পনাই এক ঐতিহাসিক সাফল্যের আকার নিল সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান CERN-এর (European Organization for Nuclear Research) বিজ্ঞানীদের হাতে। বহু শতাব্দী ধরে অ্যালকেমিস্টরা (যাদের কাজ ছিল রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন ঘটানো) চেষ্টা করে গেছেন সীসাকে সোনায় রূপান্তরিত করার। কিন্তু যেটা এতদিন ছিল রূপকথার মতো, সেটাই আজ আধুনিক বিজ্ঞানের বাস্তব চমক—যদিও তা স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ, আর একে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলা যায় না। তবুও, এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতে এক মাইলফলক তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছে।

ঘটনার শুরু CERN-এর সবথেকে বিখ্যাত যন্ত্র Large Hadron Collider বা LHC-তে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টিকল এক্সেলারেটর, যেখানে অণু-পরমাণুর উপাদান কণাগুলিকে আলট্রা-হাই স্পিডে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে পাঠানো হয়। এই পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে ALICE নামক এক বিশেষ ডিটেক্টর, যার কাজ ছিল ওই সংঘর্ষে উৎপন্ন কণাগুলির পর্যবেক্ষণ করা। এই সংঘর্ষে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়, যেখানে সীসা-প্রোটনের ভিতরের গঠন পরিবর্তিত হয়ে একেবারে নতুন মৌলিক রূপে পরিণত হয়। এই পরিবর্তনের ফলেই বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, সোনার মতো গঠন তৈরি হয়েছে—যদিও তা মাত্র সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য স্থায়ী ছিল।বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এটা কেবল সোনায় রূপান্তরের বিষয় নয়, বরং যেকোনো পদার্থকে অন্য পদার্থে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এই আবিষ্কার। CERN-এর মুখপাত্র ডঃ লুইস ফার্নান্দো জানিয়েছেন, “আমরা যেটা দেখলাম, তা নিছক এক রসায়ন নয়, বরং পদার্থবিজ্ঞানের গভীরে ঢুকে প্রমাণ করলাম, পরমাণুর গঠন কৃত্রিমভাবে পরিবর্তন করাও সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, “এই পরীক্ষা প্রমাণ করে দিল, যদি আমরা সঠিক পদ্ধতিতে এবং সঠিক শক্তি প্রয়োগ করে কণাগুলিকে সংঘর্ষ করাতে পারি, তবে প্রকৃতির মৌলিক নিয়মও খানিকটা ঘেঁটেই নতুন কিছু সম্ভব।”
কিন্তু এখানেই থেমে নেই আলোচনার জোয়ার। যাঁরা ভাবছেন এখন থেকে ল্যাবে বসেই সোনা তৈরি করা যাবে, তাঁদের জন্য কিছুটা হতাশার খবর—এই পুরো প্রক্রিয়াটি এতটাই জটিল ও ব্যয়বহুল, যে এর মাধ্যমে বানানো এক মিলিগ্রাম সোনার দামই কোটি টাকার ওপরে পড়বে। তাই একে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলা যায় না। শুধু তাই নয়, এই ‘সোনা’ কয়েক মিলিসেকেন্ডের বেশি স্থায়ীও হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ এলিনা ব্রুক বলেন, “এটা হল ‘science for understanding’, অর্থাৎ বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে, সেটা বোঝার জন্য আমরা এই পরীক্ষা করি। এটা কখনও সোনার ব্যবসার জায়গায় যেতে পারবে না, তবে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এটা এক বৈপ্লবিক অধ্যায়।”

এই আবিষ্কারের খবরে সাধারণ মানুষের কৌতূহল তুঙ্গে। কলকাতার বাসিন্দা ও বিজ্ঞানপ্রেমী শিক্ষক সমীর ঘোষ জানিয়েছেন, “ছোটবেলায় গল্প শুনতাম সীসা থেকে সোনা বানানোর। ভাবিনি সত্যিই একদিন সেটা সম্ভব হবে—even for a fraction of second!” আবার, কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী রুকমা মিত্র বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে দেয়, আজকের অসম্ভব কাল বাস্তব হয়ে উঠতেই পারে। এটা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।”তবে এখানেই উঠছে কিছু আশঙ্কার প্রশ্নও। যদি ভবিষ্যতে এধরনের কৃত্রিম পরিবর্তন আরও সহজ হয়ে যায়, তবে সেটা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, বা বিপজ্জনক মৌলিক পরিবর্তনের দিকে গিয়ে পড়তে পারে কিনা, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। তাই এই গবেষণাকে যতটা আনন্দের, ততটাই দায়িত্বশীলভাবে পরিচালনা করার প্রয়োজনও ততটাই জরুরি বলে মত গবেষণা মহলের।

এই পুরো প্রক্রিয়া এতটাই সূক্ষ্ম, এতটাই ক্ষণস্থায়ী, যে শুধুমাত্র LHC-এর মতো শক্তিশালী যন্ত্র দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। এবং LHC-তে এই পরীক্ষা করার সময় যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করতে বিজ্ঞানীদের আরও অনেক মাস সময় লাগবে। এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ডঃ জুলিয়ান থিম, যিনি বলেন, “আমরা ভবিষ্যতের পথ খুলে দিলাম, কিন্তু এই পথে হাঁটতে গেলে অনেক দূর যেতে হবে। আমাদের এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি।”
এই আবিষ্কারের অর্থনৈতিক প্রভাব না থাকলেও, একে বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মহলে ভবিষ্যতের পরমাণু পরিবর্তন, মৌল রূপান্তর এবং উচ্চ শক্তির ফিজিক্স গবেষণার ক্ষেত্রে এক দিকদর্শক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এ যেন পদার্থের ডিএনএ পরিবর্তনের মতোই একটি কল্পনা, যা আজ বাস্তবের দরজায় এসে দাঁড়াল।
সুতরাং, ‘সীসা থেকে সোনা’ এখন শুধুই গল্প নয়—তবে সেটা এখনও স্বপ্নের মতোই ক্ষণস্থায়ী। তবুও CERN-এর বিজ্ঞানীদের এই অর্জন মানুষের কল্পনার পরিসীমা ও বিজ্ঞানের সাধনার সীমা—দুটোই একসঙ্গে ছুঁয়ে গেল।