Before! 200 species legally allowed in seawater:-জলের আরেক নাম জীবন — আমরা ছোটবেলা থেকেই এই কথাটা শুনে আসছি। কিন্তু এখন সেই জলই যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যু কূপে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চল, বিশেষ করে ক্যাঙারু দ্বীপের চারপাশে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সমুদ্রের জলে হঠাৎ করে দেখা গেছে অজস্র সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ। মাছ, অক্টোপাস, কচ্ছপ, ছোট ছোট শুঁটকি থেকে শুরু করে ডলফিন পর্যন্ত — প্রায় ২০০ রকমের সামুদ্রিক প্রাণীর নিথর দেহ ভেসে উঠছে সমুদ্রের পাড়ে। একের পর এক প্রাণ হারানোর এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরাও। পরিবেশবিজ্ঞানীরা একে বলছেন ‘সমুদ্রের ভিতর বিষাক্ত বিস্ফোরণ’। কারণ, সমুদ্রের জল যেন আজ বিষে ভরে উঠেছে। এবং এই বিষের উৎস হিসেবে উঠে আসছে এক ভয়ঙ্কর ছত্রাকের নাম।বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ছত্রাক দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র জলে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যেন কোনও বিষাক্ত পদার্থ বিস্ফোরণের মতো সমুদ্রের ভিতর ছড়িয়ে পড়েছে। এই ছত্রাক শুধু ভয়ঙ্কর মাত্রায় বিষ উৎপন্ন করে তা-ই নয়, সঙ্গে সঙ্গে তা জলের অক্সিজেন শোষণ করে নেয়। ফলে সমুদ্রের ভিতরের জীববৈচিত্র্য শ্বাস নিতে না পেরে একে একে প্রাণ হারাতে থাকে। জল ঘোলাটে হয়ে যায়, তার রং বদলে যায়, এবং অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা বেড়ে যায়। এই সবকিছু মিলিয়ে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সামুদ্রিক গবেষণা সংস্থা (Australian Marine Conservation Society)-র জীববিজ্ঞানী ডঃ নিকোলাস জর্ডান জানিয়েছেন, “আমরা কখনও ভাবিনি এমন কিছু ঘটবে। একটি মাত্র ছত্রাক কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার ভয়ানক প্রমাণ এটা। ক্যাঙারু দ্বীপের প্রায় সমান আকারে সমুদ্রজুড়ে এই ছত্রাক ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এমন একটি ‘marine fungi’ যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এর বিস্তার যদি এখনই না রোখা যায়, তাহলে শুধু প্রাণহানি নয়, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ গোলার্ধের সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রই ভেঙে পড়বে।”এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উপকূলবর্তী শহর অ্যাডিলেডের মৎস্যজীবীরা। স্থানীয় জেলে রজার হ্যামিল্টন বলেন, “গত ২০ বছর ধরে সমুদ্রে মাছ ধরছি, কিন্তু এমন ভয়াবহ কিছু কখনও দেখিনি। জাল তুললেই এখন শুধু মৃতদেহ আসে। মাছ নেই, শুঁটকি নেই, জীবন নেই।” অন্যদিকে পর্যটন সংস্থাগুলিও ক্ষতির মুখে। কারণ ক্যাঙারু দ্বীপ ছিল দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকরা সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখতে এসে এখন শূন্যতা ও মৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন।
পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মী অ্যালিসা থর্নটন বলছেন, “এই ছত্রাক সম্ভবত কোনওভাবে মানব কার্যকলাপের ফলে তৈরি হয়েছে। হতে পারে দূষিত জাহাজের বর্জ্য বা সমুদ্রতটে গার্বেজ ডাম্পিং-এর কারণেই এই মিউট্যান্ট ছত্রাক জন্ম নিয়েছে। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।” তাঁর কথায়, “সমুদ্র কেবল জীবনের আধার নয়, গোটা পৃথিবীর জলবায়ুর রক্ষাকবচ। যদি এই বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়, তার ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়বে আমাদের বেঁচে থাকার উপরে।”এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সরকার তৎপর হলেও, এখনও পর্যন্ত কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীদের একটি জরুরি টাস্কফোর্স তৈরি করা হয়েছে, যাঁরা ওই ছত্রাকের জিনগত গঠন এবং এর বিস্তার রোধের রাস্তা খুঁজছেন। অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশমন্ত্রী টনি বার্ক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই বিপর্যয় শুধু অস্ট্রেলিয়ার সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক পরিবেশ সংকেত। আমরা বিশ্বজুড়ে সামুদ্রিক বিজ্ঞানীদের একত্রিত করে এর মোকাবিলা করব।”

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি এই বিষাক্ত ছত্রাক কোনওভাবে ভারত মহাসাগর বা প্রশান্ত মহাসাগরের অন্য অংশে পৌঁছে যায়, তাহলে আরও বড় মাপের বিপর্যয় আসতে পারে। সেক্ষেত্রে খাদ্যচক্র থেকে শুরু করে আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন সবই হুমকির মুখে পড়বে। ইতিমধ্যেই জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিজি, নিউজিল্যান্ডের মেরিন ইনস্টিটিউটগুলিকে এই বিষয়ে সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়েছে।এই ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী একটি প্রশ্ন উঠছে — আমরা কি সমুদ্রকে সত্যিই নিরাপদ রাখতে পেরেছি? আমাদের শিল্প বর্জ্য, অপরিকল্পিত তেল ট্যাংকার, পণ্যবাহী জাহাজ, প্লাস্টিক দূষণ আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং মিলিয়ে কি সমুদ্রকে ধীরে ধীরে বিষে পরিণত করছে না? সমুদ্রের মৃত্যুর মানে হলো পৃথিবীর প্রাণশক্তির মৃত্যুর সূচনা। কারণ পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের প্রায় ৫০% সমুদ্রজ উদ্ভিদ থেকেই আসে।
এই কারণেই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, এ যেন সমুদ্রের ভিতর কোনও নিঃশব্দ যুদ্ধ চলছে, যেটা কারখানা বা পরমাণু নয়, বরং প্রকৃতির ঘরে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে — যার নাম ‘marine fungal explosion’। এই যুদ্ধ থামাতে হলে মানুষকেই উদ্যোগ নিতে হবে — কার্বন নির্গমন কমাতে হবে, সমুদ্র দূষণ বন্ধ করতে হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, প্রকৃতির প্রতি সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে।
জল যখন প্রাণ, তখন তার মৃত্যু মানে আমাদের মৃত্যুও সময়ের অপেক্ষা। এই ‘সমুদ্র বিস্ফোরণ’ তাই শুধু কোনও এক অঞ্চল বা প্রজাতির বিপর্যয় নয়, এটি গোটা পৃথিবীর জন্য এক ভয়ঙ্কর সতর্ক সংকেত।