Elephant rampage in Jhargram, destroying paddy fields, houses : সাঁকরাইলের বড়দা গ্রামে ঠিক যেন রাতের অন্ধকারে এক বিভীষিকা নেমে এলো, যখন জঙ্গল থেকে এক দলছুট দাঁতাল হাতি হঠাৎ গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং শুরু করে তাণ্ডব। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে থাকলেও সেই ঘুম ভেঙে যায় একেকটা মাটির দেওয়ালের চিৎকারে, খুঁটি ভাঙার আওয়াজে আর কৃষিজমিতে পায়ের শব্দে। শোনামাত্র মনে হতেই পারে যেন কোনও ভূমিকম্প হয়েছে, কিন্তু না — এটা ছিল এক পশুর প্রাকৃতিক অভিশাপ, যে শুধু খাবারের খোঁজে এসেছিল, কিন্তু রেখে গেল ধ্বংসস্তূপ আর আতঙ্কের ছাপ। ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইল ব্লকের বড়দা গ্রামে এই ঘটনায় একাধিক গৃহস্থের মাটির ঘর ভেঙে গিয়েছে, নষ্ট হয়েছে বিঘার পর বিঘা ধান ক্ষেত, আর সেইসঙ্গে ভেঙে পড়েছে গ্রামের শান্ত পরিবেশ। রাতের গভীরতায়, গ্রামবাসীরা যখন বিশ্রামে, সেই সময় হঠাৎ জঙ্গলের দিক থেকে শব্দ আসতে শুরু করে, এবং মুহূর্তের মধ্যে দেখা যায় একটি দাঁতাল হাতি ঢুকে পড়েছে গ্রামে। কেউ কেউ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাতিকে দেখে ফেলেন, আর তারপর প্রাণভয়ে ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যান আশেপাশের বাড়ির লোকেরা। দাঁতালটি মাটির দেওয়াল, বাঁশের খুঁটি, কাঠের জানলা, এমনকি সিমেন্টের স্তম্ভ পর্যন্ত উপড়ে ফেলে, আর ধ্বংস করে ঘরের আসবাব, শস্য, খাবার, এমনকি স্টোরে রাখা চাল, পাট, খেতের বীজও। এর পাশাপাশি, জমির পর জমিতে লুটিয়ে ফেলে ধান গাছ, পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয় পুরো ফসল। এই মৌসুমে যাঁরা চাষে খরচা করেছেন, তাঁদের মাথায় এখন সত্যিই হাত। বড়দা গ্রামের কৃষক বাপি মাইতি বলেন, “সারা বছরের ধান চাষ এই ভরসায় করেছিলাম। এখন সব শেষ। শুধু একটা হাতি এসে বিঘার পর বিঘা জমি শেষ করে দিল। সরকার কী করবে জানি না, কিন্তু এখন আমরা নিঃস্ব।”
এই ঘটনায় সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো, দীর্ঘক্ষণ ধরেই হাতিটি গ্রামে তাণ্ডব চালালেও বনদপ্তরের কোনও প্রতিনিধি বা কর্মী উপস্থিত ছিলেন না। স্থানীয় বাসিন্দারাই শেষমেশ বাঁশ, ঢোল, মশাল, পেট্রোল ছিটিয়ে কোনোভাবে হাতিটিকে অন্যদিকে তাড়াতে সমর্থ হন। কেউ কেউ আবার এই প্রচেষ্টায় আহতও হয়েছেন। গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, “হাতির গতিবিধি সম্পর্কে তো বনদপ্তরের নজরদারি থাকার কথা, তাহলে কেন এমন একটা বিপদে কেউ এল না? আর কতবার আমাদেরকেই প্রাণ হাতে নিয়ে এসব সামলাতে হবে?”

সাঁকরাইল পঞ্চায়েতের সদস্যা সুভাষিণী সোরেন বলেন, “এই এলাকায় প্রায়ই হাতির উপদ্রব দেখা যায়, কিন্তু বারবার জানানো সত্ত্বেও বনদপ্তর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এবার তো বড় ক্ষতি হয়ে গেল। সরকার যদি এই ধরনের অব্যবস্থা বন্ধ না করে, তাহলে বড়দা সহ আশেপাশের গ্রামগুলো একের পর এক খালি হয়ে যাবে।”
ঘটনার পর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা অমরেন্দু পাত্র বলেন, “বনদপ্তরের গাফিলতিতে মানুষ প্রতিনিয়ত বিপদের মধ্যে পড়ছে। হাতির গতিবিধির ওপর নজরদারির জন্য যেসব ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাস্তবে তো কিছুই নেই। এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।”
জঙ্গলঘেরা এই এলাকায় দাঁতাল হাতির হানার ঘটনা নতুন নয়। ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল, গোপীবল্লভপুর, বিনপুর, লালগড়, বেলিয়াবেড়া – এই সব এলাকায় প্রায়শই হাতির দল নেমে আসে গ্রামে। খাবারের অভাব, জঙ্গল সঙ্কোচন, আর বনাঞ্চলের মাঝে চাষযোগ্য জমি তৈরি হওয়ার কারণে হাতিরা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদ শংকর রাউত। তিনি বলেন, “এই হাতিগুলোর জন্য কোনও করিডর নেই, ফলে তারা বাধ্য হয়ে মানুষের গ্রামে ঢুকছে। এদের জন্য আলাদা করিডর তৈরি, গাছপালা রোপণ এবং নিরাপদ খাদ্য সংগ্রহের জায়গা তৈরি না হলে এই সমস্যা থামবে না।”
এই ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এখন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু তার জন্য দরকার মাঠপর্যায়ে বাস্তবিক মূল্যায়ন। এদিকে চাষিরা বলছেন, শুধু ক্ষতিপূরণ দিলেই চলবে না, চাই স্থায়ী সমাধান।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বনদপ্তর এখন বলছে, ওই এলাকায় ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানো হবে, হাতির গতিবিধির ওপর নজর রাখা হবে, এবং ভবিষ্যতে হাতির প্রবেশ রুখতে ইলেকট্রিক ফেন্সিং-এর ভাবনাও চলছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের আস্থা ফিরছে না। তারা বলছেন, “একটা দাঁতাল এল, আর তাণ্ডব চালিয়ে গেল, আমরা মরার মতো বাঁচলাম। যদি পরের বার একদল দাঁতাল আসে, তাহলে কি হবে?”
এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বড়দার প্রতিটি গৃহস্থের ঘরে। এই ঘটনাই আবার মনে করিয়ে দিল, প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান যদি পরিকল্পিত না হয়, তাহলে তার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়। এই গ্রাম যে কেবল হাতির হানায় ক্ষতিগ্রস্ত নয়, সেইসঙ্গে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, বনদপ্তরের উদাসীনতা এবং দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অভাবও সমান দায়ী।
একদিকে কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো প্রকল্পে বড় বড় কথা বলা হয় হাতি-মানুষ সহাবস্থান, করিডর নির্মাণ, মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষ রোধ নিয়ে। কিন্তু ঝাড়গ্রামের বড়দা গ্রামের মতো জায়গায় এসে দেখা যায়, মাঠে কেউ নেই। সব নীতি শুধু নথিতে আটকে। এই ঘটনার পর কেবল ক্ষতিপূরণে না, ভবিষ্যতের জন্য বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা চাই — তা না হলে এই সাঁকরাইল, বড়দা আর গোপীবল্লভপুর কেবল সংবাদপত্রে হাতির তাণ্ডব হিসেবেই থাকবে।