28 Bangladeshi nationals caught in police net in Kabihar:বৃষ্টিভেজা রাত, নিঃশব্দে ছুটছে রেলের ইঞ্জিন, আর সেই রাতের অন্ধকারে পুলিশের তৎপরতায় ধরা পড়ল ২৮ জন বাংলাদেশি নাগরিক—ঘটনাস্থল কোচবিহারের দিনহাটা রেল স্টেশন চত্বর। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যখন শহরের বেশিরভাগ মানুষ বৃষ্টির শব্দে ঘুমিয়ে, তখন দিনহাটা থানার পুলিশ গোপন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে এই বাংলাদেশি নাগরিকদের। ধৃতদের মধ্যে ১১ জন পুরুষ, ৮ জন মহিলা এবং ৯ জন শিশু রয়েছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ধৃতদের সকলের বাড়ি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায়। প্রায় দুই দশক আগে তাঁরা জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করে হরিয়ানার বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছিলেন। হরিয়ানাতেই স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছিলেন তাঁরা, কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা পুলিশের তৎপরতা ও ধরপাকড়ের ভয়ে তাঁরা সেখান থেকে পালিয়ে প্রথমে বিহারের গয়ায় আশ্রয় নেন। তবে সেখানেও পুলিশের কড়া নজর এড়ানো সম্ভব হয়নি। শেষমেশ, গাড়ি করে তাঁরা এসে পৌঁছেছিলেন দিনহাটার রেল স্টেশনে, যেখানে বৃষ্টির রাতে তাঁরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে দিনহাটা থানার পুলিশ সেই রাতেই সেখানে অভিযান চালায়। সন্দেহজনকভাবে আচরণ করায় পুলিশের নজর এড়াতে পারেননি তাঁরা। ধৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের পরিকল্পনা ছিল দিনহাটা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া।

কোচবিহার জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কৃষ্ণ গোপাল মিনা সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “গোপন সূত্রে খবর পেয়েই আমাদের টিম দিনহাটা স্টেশনে অভিযান চালায়। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাঁরা বাংলাদেশি নাগরিক। তাঁদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আদালতে পেশ করা হয়েছে।” মিনা আরও জানান, বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “সীমান্ত শহর হওয়ায় কোচবিহার অনেক সময়েই অনুপ্রবেশের জন্য বেছে নেওয়া হয়। তবে আমাদের পুলিশ প্রশাসন সতর্ক রয়েছে।”
এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে। দিনহাটা বাজার এলাকার এক দোকানদার স্বপন সাহা বলেন, “এভাবে বাংলাদেশিরা বারবার ঢুকে পড়ছে। পুলিশের নজরদারি না থাকলে আরও বড় বিপদ হতে পারত। আমরা চাই প্রশাসন আরও কড়া হোক।” অন্যদিকে, কোচবিহার কলেজের এক শিক্ষার্থী রূপম দাস জানান, “আমরা নিরাপত্তা চাই। কে কখন এসে কী করছে, সেটা বোঝা দায় হয়ে যাচ্ছে। পুলিশকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তবে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি আরও জোরদার করা উচিত।”
কেন্দ্রীয় সরকারের অনুপ্রবেশ বিরোধী কঠোর নীতি এবং সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের চিহ্নিত করে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, হরিয়ানায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করা এই বাংলাদেশিরা সেখানে নির্মাণ শ্রমিক, বাড়ির কাজের লোক, কারখানার শ্রমিকের কাজ করতেন। তবে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালাচ্ছিলেন।
এই ঘটনার পর কোচবিহারের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (BSF)-এর এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তৎপরতা নিয়মিতভাবে নজরে আসে। আমরা সীমান্ত এলাকায় টহলদারি আরও বাড়াচ্ছি। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় রেখে কাজ করা হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, এই ঘটনা বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় ঘোষ বলছেন, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ইস্যুটা বরাবরই সংবেদনশীল। এই ধরনের ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। আবার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নও জোরালোভাবে সামনে আসছে।”
এরই মধ্যে দিনহাটা স্টেশনে ধৃত বাংলাদেশি নাগরিকদের গ্রেপ্তার ও আদালতে পেশ করার খবর ছড়িয়ে পড়তেই শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কের আবহ। অনেকে বলছেন, “যদি বাংলাদেশিরা এভাবে বারবার অনুপ্রবেশ করতে পারে, তাহলে আমাদের নিরাপত্তার কী হবে?” আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, “এই মানুষগুলোরও তো একটা জীবনের গল্প আছে। কাজের জন্য দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা কি দেশে ফিরলে নিরাপদে বাঁচতে পারবেন?”

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মানবিক দিকটাও উঠে আসছে। বিশেষ করে ধৃতদের মধ্যে ৯ জন শিশু রয়েছে—যাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। শিশু অধিকার সংরক্ষণকারী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে তাঁদের আইনি সহায়তা ও মানবিক সহায়তার দাবিও উঠতে শুরু করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ধরপাকড় আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আরও কার্যকরী সমঝোতা ও সহযোগিতার প্রয়োজন বলে মতামত বিশ্লেষকদের।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, কোচবিহারে এই ২৮ বাংলাদেশি নাগরিকের গ্রেপ্তার শুধুমাত্র একটি ঘটনা নয়—এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের সীমান্ত সমস্যা, নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতা, এবং মানবিকতার এক বড় প্রশ্নচিহ্ন।