19 killed in lightning strikes in Bihar in two days!: বিহার যেন আচমকাই পরিণত হয়েছে এক মৃত্যুপুরীতে, কারণ গত দু’দিন ধরে বজ্রপাত, ঝড়, শিলাবৃষ্টি—সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন চরম রূপ ধরেছে। আবহাওয়া দপ্তর আগে থেকেই সতর্ক করেছিল যে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত, বিশেষ করে ১২ তারিখ পর্যন্ত বিহারের বেশ কয়েকটি জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ, শিলাবৃষ্টি এবং ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সতর্কবার্তা যে কতটা বাস্তব এবং কতটা ভয়ানক হতে পারে তা বিগত ৪৮ ঘণ্টায় প্রমাণ করে দিল প্রকৃতি। মঙ্গলবার ও বুধবার, এই দু’দিনেই বজ্রপাতের ফলে বিহারের ৭টি জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন মোট ১৯ জন মানুষ। এমন এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে আকাশের দিকে তাকালেই আতঙ্ক জমে আসছে গ্রামের সাধারণ মানুষের চোখে মুখে। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন চাষের কাজে ব্যস্ত কৃষক, কেউ ছিলেন গৃহস্থালির কাজে মাঠে, আবার কেউ কেউ ছিলেন গবাদি পশু নিয়ে খোলা আকাশের নিচে। বজ্রপাত এতটাই হঠাৎ এবং তীব্র ছিল যে কারও কিছু বুঝে ওঠার সময়ই মেলেনি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে বেগুসারাই এবং দ্বারভাঙা জেলায়—এই দুই এলাকাতেই প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। মধুবনিতে মৃত্যু হয়েছে আরও তিনজনের। বাকিরা গয়া, খগাড়িয়া, পূর্ণিয়া ও বৈশালীর বাসিন্দা। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বজ্রপাতের সময় মানুষ খোলা জায়গায় ছিলেন। কোনও গাছের নিচে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন, কেউ বা মাঠে গবাদি পশু তুলছিলেন। সেইসময়ই বজ্রপাতের কবলে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়। মৃতদের পরিবারের সদস্যরা এখন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন। দ্বারভাঙার বাসিন্দা সুলেখা দেবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার ছেলে তো শুধু গরুগুলোকেই মাঠ থেকে বাড়ি আনতে গিয়েছিল, আমি ভাবতেও পারছি না ও আর ফিরে আসবে না।
” তার পাশেই এক বৃদ্ধ কৃষক বললেন, “আকাশে মেঘ ছিল ঠিকই, কিন্তু এতটা ভয়াবহ হবে ভাবিনি, আমরা তো চিরকাল এইরকম আবহাওয়া দেখে এসেছি, কিন্তু এখনকার বজ্রপাত যেন আগুনের মতো, কিছুই বাঁকানো যায় না।” এই ঘটনার পর বিহার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। গ্রামের পর গ্রাম এখন যেন কেবলই প্রার্থনা করছে—আকাশটা একটু শান্ত থাক, বজ্রপাত যেন না হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে অনেক এলাকা। কৃষকদের কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলত, মানুষের দৈনন্দিন জীবন, রুজি-রোজগার, চাষবাস—সবকিছুই তলানিতে এসে ঠেকেছে। একইসঙ্গে আহত হয়েছেন বহু মানুষ, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। তাদের স্থানীয় হাসপাতাল এবং জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এই ঘটনার পর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং জানিয়েছেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। একইসঙ্গে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দ্রুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে।” মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এখন প্রতিটি জেলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। জারি করা হয়েছে হেল্পলাইন নম্বর, এলাকা ভিত্তিক মাইকে প্রচার করা হচ্ছে, বজ্রপাতের সময় মানুষ যেন ঘরের বাইরে না যান, গাছ বা খোলা মাঠে আশ্রয় না নেন, তাও জানানো হচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাত হলো এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বহু মানুষের প্রাণ নিয়ে চলে যায়। শুধুমাত্র বিহারেই বিগত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ফলে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। ২০২০ সালে একদিনে ৮৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা এখনও কারও ভোলার কথা নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাতের ঘটনা আরও বেশি হচ্ছে। বাতাসে আর্দ্রতা, মেঘের ঘনত্ব এবং উত্তপ্ত জমির সংস্পর্শে বিদ্যুতের নির্গমন বাড়ছে, ফলে একে অপরের সংস্পর্শে আসার সময় মারাত্মক শব্দ ও বিদ্যুতের সৃষ্টি হচ্ছে, যার নামই বজ্রপাত। এই বজ্রপাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সচেতনতা।

কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, আগামী কয়েকদিনেও আবহাওয়া একই রকম থাকতে পারে, ফলে সবাইকে সাবধান থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের জন্য নতুনভাবে সতর্কতা মেনে চলার নির্দেশও জারি হয়েছে। এদিকে সামাজিক মাধ্যমে এই মৃত্যু মিছিল ঘিরে শোকপ্রকাশের পাশাপাশি উঠছে প্রশ্নও—এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আমরা কি বজ্রপাত রোধে কোনও প্রযুক্তি বা বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে পারি না? অনেকেই লিখেছেন, “শুধু টাকা দিয়ে মৃতের পরিবারকে শান্ত করা যায় না, বরং ভবিষ্যতে এইরকম ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকারকে আরও আধুনিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।” অনেকেই বলছেন, বজ্রপাতের সতর্কতা অনেক সময় মানুষ গুরুত্ব দেন না, আর তার ফলেই বাড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। এই কারণেই স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে স্কুল পর্যায়ে প্রচার বাড়ানোর দাবিও উঠেছে। শিশুদের মধ্যেও এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের ভয় সৃষ্টি করেছে। এক কিশোর বলছে, “আগে আমরা বৃষ্টি হলে ভিজতে ভিজতে খেলতাম, এখন বৃষ্টি মানেই ভয় করে, বজ্রপাত নামলে কি হবে কে জানে!” সবমিলিয়ে একটি সাধারণ আবহাওয়া সতর্কতা কীভাবে প্রাণঘাতী বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে, তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রইল বিহারের এই বজ্রপাত কাণ্ড। আগামী দিনে এর থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু বিহার নয়, গোটা দেশেই বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে আরও বেশি সচেতনতা, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে, কারণ প্রকৃতি কখন যে রুদ্র রূপ নেবে, তা আগাম বলে দেওয়া সত্যিই কঠিন।