10-inch statue made by Nadia artist to travel to distant England : আষাঢ়ের বৃষ্টি পেরিয়ে সাদা কাশফুলের আবির্ভাব, পেজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো মেঘ আর হালকা ঠান্ডা হাওয়া জানান দিচ্ছে—আসছে পুজো। আর এই পুজোর আগেই নদিয়ার শান্তিপুরের এক নিঃশব্দ শিল্পী সাড়া ফেলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। তাঁর হাতের গড়া ১০ ইঞ্চির দুর্গা প্রতিমা এবার পাড়ি দিচ্ছে সুদূর ইংল্যান্ডে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন! নদিয়ার চৌগাছা পাড়ার প্রতিভাবান মৃৎশিল্পী সুমিত পাল, যাঁর শিল্পীর জীবন শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে, আজ বিশ্বমঞ্চে বাংলার মাটির গন্ধ পৌঁছে দিচ্ছেন। ছোটবেলায় কাদামাটি নিয়ে খেলতে খেলতেই জন্মেছিল শিল্পের প্রতি ভালোবাসা। এরপর সেই ভালোবাসা রূপ নিয়েছে নিপুণ হাতে গড়া দুর্গা প্রতিমার মধ্যে। সুমিতবাবুর কথায়, “ইংল্যান্ডের এক বাঙালি পরিবারের অর্ডারে তৈরি করেছি এই প্রতিমা, উচ্চতা ১০ ইঞ্চি হলেও তাতে মাটির গন্ধ, বাংলার আবেগ, এবং আমার পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে।” গত ১৫ দিন ধরে দিনরাত এক করে এই প্রতিমা তৈরির কাজে লেগেছিলেন তিনি। প্রতিমাটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়েছে মাটি, শোলা ও প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে। দেবী দুর্গার দশ হাতে অস্ত্র, অসুর বধের প্রতীক ত্রিশূল, সিংহের রুদ্র রূপ—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মূর্তির নিদর্শন তৈরি করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, প্রতিমার মুখাবয়ব ফুটিয়ে তোলার সময় তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন শান্ততা ও মাতৃত্বের অনুভবকে। শিল্পী আরও জানান, “ইংল্যান্ডে এই প্রথম আমার প্রতিমা গেলেও এর আগে মেক্সিকোতেও গিয়েছিল আমার তৈরি প্রতিমা।
এই অনুভব ভাষায় বোঝানো যায় না, নিজের দেশ, নিজের শহর, নিজের বাংলার সংস্কৃতি বিদেশের মাটিতে পৌঁছে দেওয়া সত্যিই এক অনন্য গর্ব।” সুমিত পালের এই কৃতিত্বে আনন্দে মুখরিত তাঁর পরিবারও। মা কাকলি পাল বলেন, “ছেলের পরিশ্রম সফল হয়েছে। আমরা ছোটবেলায় ওকে দেখে বুঝেছিলাম, ওর মধ্যে কিছু একটা আলাদা আছে।” বাবাও জানান, “অনেক কষ্ট করে পড়াশোনার পাশাপাশি এই শিল্পচর্চা চালিয়ে গিয়েছে সুমিত, আজ তার ফল মিলছে।” স্থানীয় বাসিন্দারাও গর্বিত। চৌগাছা পাড়ারই এক বাসিন্দা শ্রীমতী অনুরাধা দত্ত বলেন, “আমাদের পাড়ার একটা ছেলে আজ সারা বিশ্বে বাংলার নাম ছড়াচ্ছে, এ তো আমাদের সকলের গর্ব।” শান্তিপুর মৃৎশিল্পের জন্য আগেও খ্যাতি অর্জন করেছে, কিন্তু এত ছোট আকারে, এত সূক্ষ্ম কাজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এই প্রথম। এই প্রতিমা শুধু একটা মূর্তি নয়, এই প্রতিমা বহন করে বাংলার মাটি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার আবেগ। শিল্পী সুমিত পাল এর আগে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন কলকাতা, শান্তিনিকেতন, দুর্গাপুর, এমনকি ভুবনেশ্বরেও। অংকনে তাঁর দক্ষতা আগেই বহুবার প্রশংসা কুড়িয়েছে, এবার মৃৎশিল্পেও ছাপ রাখলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। ইংল্যান্ডে অবস্থিত “Durga Puja Association of Leeds”-এর তরফ থেকে এই প্রতিমা পাঠানো হচ্ছে। ওই সংস্থার এক সদস্য টেলিফোনে জানান, “আমরা প্রতিমা চাইছিলাম যেটা আমাদের আবেগের সঙ্গে মিলবে, ছোট হলেও যেন তাতে মা দুর্গার উপস্থিতি অনুভব করা যায়—সুমিতবাবুর কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ।” এই ঘটনার প্রভাবও স্পষ্ট। নদিয়ার অন্যান্য তরুণ শিল্পীরাও এখন অনুপ্রাণিত।

অনেকেই যোগাযোগ করছেন সুমিত পালের সঙ্গে, শিখতে চাইছেন। জেলা শিল্প মেলা কমিটির তরফেও জানানো হয়েছে, এবার থেকে স্থানীয় শিল্পীদের উৎসাহ দিতে আলাদা বুথ দেওয়া হবে যেখানে আন্তর্জাতিক এক্সপোর্টের জন্য প্রতিমা ও শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে নদিয়ার শিল্পপরিমণ্ডলে এক বড় অধ্যায় খুলে দিল। এমন প্রতিভা লুকিয়ে থাকে আমাদের আশেপাশেই, প্রয়োজন শুধু সেই প্রতিভাকে বোঝার এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সরকারের তরফ থেকেও এই শিল্পীর প্রতি যদি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা আসে, তবে আগামী দিনে আরও বহু আন্তর্জাতিক দুর্গাপুজোয় বাংলার প্রতিমা দেখতে পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে সুমিত পাল জানান, “আগামী বছর আমেরিকা ও জার্মানিতেও আমার প্রতিমা পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আমি চেয়েছিলাম বাংলার দুর্গা বাংলার বাইরে গিয়ে মাটির গন্ধ ছড়াক, সেটা যদি আমার হাত ধরে সম্ভব হয়, তাহলে আমি ধন্য।” এইভাবে এক একজন শিল্পীর হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মাটি। আগামী দিনে যেন আরও অনেক সুমিত পাল উঠে আসেন বাংলার প্রতিটি পাড়ার গলি থেকে, যারা তাদের কাজ দিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে—বাংলার মাটি শুধু নরম নয়, সেখানে জন্ম নেয় শক্তি, সৃষ্টি আর গর্বের ইতিহাস। আর এবছর পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ার আগেই ইংল্যান্ডের আকাশে উড়ে যাবে বাংলার দুর্গা—একটা ছোট ১০ ইঞ্চির প্রতিমা, কিন্তু তাতে ভরপুর একটা জাতির সংস্কৃতি, আবেগ আর শিল্পবোধ।