সমুদ্রের অতল গভীরে আবারও দেখা মিলল এক রহস্যময় মাছের, যাকে নিয়ে মানুষের মনে জাগছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, রহস্য আর ভীতি। ডুমস ডে ফিশ বা কেয়ামতের মাছ নামে পরিচিত এই অদ্ভুত জীবটি সম্প্রতি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। সমুদ্রগামী ডুবুরিদের একটি দল সমুদ্রের প্রায় ১,০০০ মিটার গভীরে অনুসন্ধান চালানোর সময় এই মাছটির মুখোমুখি হন। লম্বা ইস্পাতের চাবুকের মতো দেহ এবং বড় বড় চোখওয়ালা এই মাছটি দেখে ডুবুরিরা চমকে যান। ভিডিওতে দেখা যায়, মাছটির গায়ে হালকা হাত লাগাতেই সেটি ধীরে সরে যায়, আর এই পুরো ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।
ডুমস ডে ফিশ মূলত অরফিশ নামে পরিচিত, এবং এটি গভীর সমুদ্রে বাস করা একটি বিরল প্রজাতি। সাধারণত এই মাছের দেখা খুব কমই মেলে, কারণ এটি সমুদ্রের ৭০০ থেকে ৩,২০০ ফুট নিচে থাকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, জাপানের লোককথায় এই মাছটিকে বলা হয় ‘রিউগু নো সুকাই’, অর্থাৎ ‘সমুদ্র ঈশ্বরের বার্তাবাহক’। লোককাহিনীতে বলা হয়, যখনই অরফিশ সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসে, তখন বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষত ভূমিকম্প বা সুনামি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই মাছের উপস্থিতি অনেকের মনে ভীতি ও কৌতূহল জাগিয়েছে। স্থানীয় অনেকেই এই মাছের দেখা পাওয়াকে অশুভ সংকেত বলে মনে করছেন।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই মাছ গভীর সমুদ্রের পরিবেশের প্রতিচ্ছবি। সমুদ্রের তাপমাত্রা, জৈবিক ভারসাম্য বা টেকটোনিক পরিবর্তনের কারণে এই মাছ মাঝেমধ্যে সমুদ্রের গভীর থেকে উপরের দিকে উঠে আসে। এই ধরনের মাছের দেখা পাওয়া সমুদ্রের পরিবেশের অস্বাভাবিকতা নির্দেশ করতে পারে। সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশ কয়েকটি অরফিশ দেখা যাওয়ার পর ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছিল। তাই অনেকেই মনে করছেন, এবারও হয়তো এমন কিছু ঘটতে পারে। যদিও বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নন, তবুও এই ধরনের মাছের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।
এই ঘটনার পর স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ এই মাছটিকে শুভ লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। বর্ষীয়ান মৎস্যজীবী অরুণ মণ্ডল বললেন, “আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, অরফিশ দেখা মানেই সমুদ্রের পরিবেশ ভালো আছে। এমনিতে মাছ কম পাচ্ছিলাম, এখন মনে হচ্ছে সমুদ্র আমাদের আরও দানশীল হবে।” তবে অন্যদিকে কিছু মানুষ ভয় পেয়ে গেছেন। তারা মনে করছেন, এই মাছ কেয়ামতের আগমনের বার্তা নিয়ে এসেছে। এক তরুণ মৎস্যজীবী দীপঙ্কর দাস জানালেন, “ভূমিকম্প বা সুনামি নিয়ে যে কথাগুলো শোনা যায়, সেটা সত্যি হলে আমাদের খুব বিপদ হবে। আমরা সাগরের ওপর নির্ভরশীল, তাই এই ধরনের খবর শুনলেই ভয় লাগে।”
বিজ্ঞানীরা অবশ্য ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই বলে আশ্বস্ত করছেন। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ড. সুধাংশু চ্যাটার্জি জানিয়েছেন, “অরফিশের দেখা পাওয়া বিরল, কিন্তু এটা কোনো বিপর্যয়ের সঠিক পূর্বাভাস নয়। বরং এটা সমুদ্রের গভীরে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, সে বিষয়ে গবেষণার সুযোগ দেয়।” তাঁর মতে, হয়তো সামুদ্রিক পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়েছে বা খাদ্যশৃঙ্খলে কোনো পরিবর্তন এসেছে, যার জন্য এই মাছ উপরে উঠে এসেছে। তিনি আরও বলেন, “ভূমিকম্প বা সুনামির সম্ভাবনা থাকলেও সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তাই গুজবে কান না দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের ওপর ভরসা করা উচিত।”
এই মাছের ভিডিও এবং ছবি ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। কেউ কেউ মজার মিম তৈরি করেছেন, আবার কেউ কেউ এই ঘটনাকে ‘কেয়ামতের সংকেত’ বলে মন্তব্য করছেন। এবং দেখা যাচ্ছে টুইটার, ইনস্টাগ্রামে ট্রেন্ডিং। বিজ্ঞানীরা যেখানে এটিকে গবেষণার বিষয় হিসেবে দেখছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ভয় ও কৌতূহল দুই-ই কাজ করছে।
ডুমস ডে ফিশের দেখা পাওয়া নিয়ে যতই আলোচনা বা গুজব থাকুক না কেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ইঙ্গিত। গভীর সমুদ্রের পরিবেশ যদি পরিবর্তিত হয়, তাহলে তার প্রভাব সরাসরি মানুষের ওপর পড়বে। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের মাছের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যতে সমুদ্রের স্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নিয়ে আরও গবেষণা চালাবেন। আর সাধারণ মানুষকেও গুজবে কান না দিয়ে পরিবেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞানচর্চায় মনোযোগ দেওয়া উচিত।
সমুদ্রের অতল গভীরে বাস করা এই রহস্যময় অরফিশ যেন প্রকৃতির এক অজানা বার্তাবাহক। এটি কেয়ামতের বার্তা বহন করছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে বিজ্ঞানকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ডুমস ডে ফিশ আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হতে পারে—হয়তো প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট না করতে এটাই তার অদ্ভুত ভাষায় আমাদের উদ্দেশ্যে একটি মৃদু স্মরণ করিয়ে দেওয়া।