Sunday, April 13, 2025
Google search engine
HomeUncategorisedবজ্রাঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ঢাল তালগাছ

বজ্রাঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ঢাল তালগাছ

“তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে” – ছোটবেলায় পড়া এই লাইনটা যেন আজ নতুনভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, কারণ তালগাছ এখন শুধু ছায়া দেয় না, প্রাণও বাঁচায়। এক সময়ে যার ছায়ায় খেলাধুলা করত গ্রামের ছেলে-মেয়েরা, সেই তালগাছই আজ রীতিমতো ‘প্রাকৃতিক বজ্র নিরোধক’। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে যখন প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বজ্রপাতের খবর উঠে আসছে, তখন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, তালগাছই হতে পারে গ্রামের মানুষের প্রাণরক্ষার ঢাল। বর্তমান সময়ে এপ্রিল থেকে জুলাই – এই কয়েকটা মাস বজ্রপাতের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মাঠে কাজ করা কৃষক, স্কুলে যাওয়া বাচ্চা, রাস্তা পার হওয়া পথচারী – কেউই নিরাপদ নয়। বজ্রপাত এতটাই হঠাৎ আসে যে পালানোর বা লুকানোর সময়ও পাওয়া যায় না। আর ঠিক সেই কারণেই প্রাকৃতিকভাবে বজ্রপাত শোষণ করার ক্ষমতা রাখে এমন গাছ গড়ে তোলা খুব দরকার, আর তালগাছ সেই তালিকায় এক নম্বরে।

পরিবেশবিদ দিলীপ পাত্র জানিয়েছেন, “তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে, যা ইলেকট্রনের কণা শোষণ করতে পারে। ফলে এটি প্রাকৃতিকভাবে বজ্রপাত নিরোধ করতে সক্ষম।” শুধু তাই নয়, তালগাছের উচ্চতা বেশি এবং গঠনগতভাবে এটি এমনভাবে দাঁড়ানো যে বজ্রপাতের সময় তার দেহের মধ্যে দিয়ে সেই প্রবাহ মাটিতে পৌঁছে যায়, আশেপাশের মানুষ বা গবাদি পশুর গায়ে লাগার সুযোগই থাকে না। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, মেদিনীপুরে আগেও প্রচুর তালগাছ দেখা যেত। এখন সেসব গাছ কাটা পড়েছে, জায়গা হয়েছে বাড়ি বা দোকানের। ফলত সেই এলাকাগুলিতে বজ্রঘাতজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৪ সালে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে বজ্রঘাতে ১২০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে – যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল কৃষক বা খোলা মাঠে কাজ করছিল এমন মানুষ। এই মৃত্যু গুলিকে প্রতিহত করতে হলে এখন থেকেই তালগাছ রোপণ শুরু করতে হবে, বিশেষ করে রাস্তার ধারে, মাঠের পাশে, স্কুল বা হাসপাতালের চারপাশে।

বীরভূম জেলার এক গ্রামে, যেখানে কয়েক বছর আগে গ্রামের প্রবীণেরা মিলিত হয়ে প্রায় ১০০টি তালগাছ লাগিয়েছিলেন, সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে বজ্রঘাতের ঘটনা অনেকটাই কমে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা নির্মল হালদার বললেন, “আগে আমাদের গ্রামে প্রতি বছর ২-৩ জন বজ্রপাতে মারা যেত, কিন্তু গত তিন বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই তালগাছগুলোর জন্যই এমন হয়েছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।” শুধুই বজ্রপাত রোধ নয়, তালগাছ মাটির ক্ষয়ও কমায়, ভূমিক্ষয় রোধ করে, এমনকি বন্যার সময় জমিতে জল দাঁড়াতে না দিয়ে দ্রুত তা শুষে নেয়। তাল গাছের ফল তাল, যা গরমকালে শরীর ঠান্ডা রাখে, আবার তালপাতার পাখা, ঝুড়ি – নানা ব্যবহারিক দিকও রয়েছে। অর্থাৎ তালগাছ একটা পরিপূর্ণ উপকারী গাছ। অথচ এই তালগাছই দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, “একটা তালগাছ বেড়ে উঠতে সময় নেয় ঠিকই, কিন্তু একবার দাঁড়িয়ে গেলে শতবর্ষ বেঁচে থাকতে পারে। অথচ আজকালকার ছেলে-মেয়েরা শুধু আম, কাঁঠাল, লিচুর চারা লাগাচ্ছে – তালকে ভুলে যাচ্ছে।’’ স্কুলের সিলেবাসে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা পড়ানো হচ্ছে, সেখানে ‘তালগাছ বাঁচাও’ অভিযান চালানো খুব দরকার। সরকার যদি স্কুলপড়ুয়া বা কৃষকদের তালগাছ লাগানোর জন্য উৎসাহ দেয়, এমনকি পুরস্কার ঘোষণা করে, তাহলে আগামী ৫-১০ বছরে আমরা অনেক প্রাণ বাঁচাতে পারব।

পরিবেশ সংস্থা ‘সবুজ বাংলা’ এর তরফে রেণু বাগ জানান, “আমরা বিভিন্ন পঞ্চায়েতে তাল গাছের চারা বিলি করছি, আর মানুষজনও এখন আগ্রহী হচ্ছেন। কারণ, এখন বজ্রপাত আর শুধু খবর নয়, বাস্তব আতঙ্ক।” সম্প্রতি নাসা ও আইএমডি (ভারতীয় আবহাওয়া দফতর) এর গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম বজ্রপাত প্রবণ রাজ্য হয়ে উঠেছে। বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকলে আগে থেকে সতর্কতা জারি হয় ঠিকই, কিন্তু সবসময় তা যথাসময়ে পৌঁছায় না গ্রামের মানুষদের কাছে। তাই তালগাছই এখন হয়ে উঠেছে গ্রাম বাংলার নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক ঢাল। একদিকে বৈজ্ঞানিক তথ্য, অন্যদিকে প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা – সবকিছু মিলিয়ে তালগাছ এখন শুধুই কবিতার গাছ নয়, এটি প্রাণ বাঁচানোর গাছ। একে রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনই আরও বেশি করে রোপণ করাও সময়ের দাবি। ‘তালগাছ বাঁচাও, প্রাণ বাঁচাও’ এখন একটাই স্লোগান হওয়া উচিত গোটা বাংলার। আজ যদি আমরা এই সহজ অথচ উপকারী গাছকে গুরুত্ব দিই, তাহলে আগামী প্রজন্ম একটি সুরক্ষিত ও সবুজ বাংলায় বড় হতে পারবে। এখন সময় হাতে আছে, সচেতনতার অভাব থাকলে কিন্তু ভবিষ্যত অনেক কঠিন হয়ে যাবে। চলুন, তালগাছ লাগাই, বজ্রপাত ঠেকাই, প্রাণ বাঁচাই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments